নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি: হুগলির পাণ্ডুয়া, সরাই দিঘীরপাড়ের এক ছোট্ট বাড়ি। তবে বাড়ির দেওয়ালে কোনো সাধারণ ছবি নয়,ফুটে উঠেছে আদিবাসী ইতিহাসের এক অধ্যায়। এখানে এক যুবক নিজের দক্ষ হাতের জাদুতে গ্রামকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আদিবাসী মনীষী, স্বাধীনতা সংগ্রামী আর সাংস্কৃতিক প্রতীকদের সঙ্গে। এই যুবকের নাম সুজয় মূর্মু। তাঁর বাড়ির দেওয়াল যেন একটি জীবন্ত ইতিহাস বই, যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটেছে।
পান্ডুয়ার এই এলাকায় রয়েছে প্রায় ৫০টি আদিবাসী পরিবার। কোথাও টালির ছাউনি, কোথাও কংক্রিটের একতলা বা দোতলা বাড়ি। কিন্তু এই সব বাড়ির মধ্যে বিশেষ নজর কাড়ে সুজয় মূর্মুর বাড়ি। তাঁর মাটির দেওয়াল আর টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ি যেন এক শিল্পগ্যালারি। বাড়ির গেটে ছোটা ভিম ও টম অ্যান্ড জেরি, আর ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে গোপাল ভাঁড়, বাঁটুল দি গ্রেট, ডোরেমন, মিকি মাউসের মতো জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র।তবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বাড়ির একটি বিশেষ দেওয়াল, যেখানে আঁকা রয়েছে ভারতের বিভিন্ন মনীষী, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আদিবাসী সমাজের প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বদের ছবি। যেমন বাবা তিলকা মাঝি, যিনি ভারতের প্রথম শহীদ হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। এছাড়াও রয়েছেন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব এবং তাঁদের দুই বোন ফুলো ঝানু। আরও দেখা যায় বিরসা মুন্ডা, পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু এবং ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী শিবু সরেন ও হেমন্ত সরেনের ছবি।
সুজয়ের আঁকা ছবির মাধ্যমে গ্রামে পরিচিতি পেয়েছে সাঁওতালি ভাষার অক্ষরও। দেওয়ালে অল চিকি ও আড়াং চিকি ভাষায় লেখা রয়েছে বাংলা ও সাঁওতালি ভাষার বিভিন্ন অক্ষর। ওপরের অংশে ৩৫টি সাঁওতালি বর্ণমালা এবং নিচে এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা। সুজয় জানায়, সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা এবং আদিবাসী মনীষীদের অনেকেই চেনেন না। তাই এই ছবিগুলি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার একটি প্রচেষ্টা।
সুজয় ছোট থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি আগ্রহী। হাওড়ার বঙ্গীয় সংগীত পরিষদ থেকে অঙ্কনরত্ন পাস করে সে। বর্তমানে বিষ্ণুপুর মল্লভূমি বিএড কলেজ থেকে সাঁওতালি ভাষায় পড়াশোনা করছে। ২০২২ সালে সাঁওতালিতে এমএ পরীক্ষায় গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে সে। ছবি শেখানোর পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতিও নিচ্ছে সে। সুজয়ের দাদা মৃত্যুঞ্জয় মূর্মু বলেন, “আমাদের ঘরের সৌন্দর্য যেমন বেড়েছে, তেমনই আদিবাসী মনীষী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মানুষ সহজেই চিনতে পারছে। ভাইয়ের এই সৃজনশীল কাজ আমাদের গর্বিত করেছে।” সুজয়ও জানায়, “আমরা চাই, মানুষ আমাদের মনীষীদের চিনুক, তাঁদের অবদান বুঝুক। তাই ছবির নিচে নাম লিখিনি। যদি কেউ জানতে চান, আমরা নিজে তাদের গল্প বলি।”
সুজয়ের এই শিল্পকর্ম শুধু তাঁর বাড়ির নয়, গোটা গ্রামবাসীর গর্বের বিষয়। ঐতিহ্য, শিক্ষা আর সচেতনতার এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটিয়ে সুজয় মূর্মু এক নতুন ইতিহাস গড়ছে পান্ডুয়ার বুকে।