জানুয়ারি কেন বছরের প্রথম মাস?

ইতিহাস

নিউজ পোল ব্যুরো: জানুয়ারি মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে আমরা কেন গ্রহণ করেছি, তার পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। প্রাচীন কালের ক্যালেন্ডার ব্যবস্থা এবং রোমান সভ্যতার প্রভাবের ফলস্বরূপ, জানুয়ারি মাসকে বছরের সূচনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই প্রথা কিভাবে শুরু হল এবং কেন এটি আজও প্রচলিত রয়েছে? ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় মূলত, রোমান পেগান উৎসব এই দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা চালু করেছিলেন তার সূত্র ধরেই এমন ঘটনা। রোমান ক্যালেন্ডার চাঁদের পর্যায়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। প্রথমে এই ক্যালেন্ডারে ছিল ১০ মাস এবং বছরের শুরু ছিল মার্চ মাসে। কিন্তু এটি ছিল অগোছালো। তাছাড়া এটি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ও অসুবিধা সৃষ্টি করত।

ইতিহাস আরো বলে, প্রায় ৪ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়াতে প্রথমবার নতুন বছর উদযাপন করা হয়েছিল। সেই সময় অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘আকুতি’।সেই সময় রাজা কে নতুন মুকুট পরানো হত। জানুয়ারি নয় মার্চের যে দিন ও রাত সমান হয় সেদিন নতুন বছর উদযাপন হত।

আরো জানা যায় যে, বেশ কিছু মহাজাগতিক বিষয়কে মাথায় রেখে নতুন বছরের দিনক্ষণ ঠিক হত। আজ থেকে ৮ হাজার বছর আগে স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিনশয়ারের উপজাতি সম্প্রদায়ের পশু শিকারি গোষ্ঠী প্রথমে ক্যালেন্ডার তৈরি করে। প্রাচীন মিশরে নতুন বছর শুরু হতো সিরিয়াস গ্রহ যেদিন দেখা যেত সেদিন। সাধারণত সময়টা জুলাই মাসে হত। মিশরীয়রা নতুন বছর উদযাপন করত ৫ দিন ধরে। তারপর শুরু হত তাদের ১২ মাসের ক্যালেন্ডার এর প্রথম মাস, যার প্রতিটি মাস ছিল ৩০ দিনের।

খ্রিস্টপূর্ব ৭১৩ সালে রোমান রাজা নুমা পম্পিলিয়াস নতুন দুটি মাস সংযোজন করেন: জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারি মাসটি ছিল দেবতা জানুসকে উৎসর্গ করা মাস। জানুস হচ্ছেন দ্বিমুখি দেবতা অর্থাৎ তাঁকে দুটি মুখ দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে। তাঁকে রূপান্তরের দেবতাও বলা হয়। অর্থাৎ যেকোনো পরিবর্তনের শুরু এবং শেষের প্রতীক। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডায়ানা স্পেনসারের মতে, জানুসের দুটি মুখের একটি সামনের দিকে এবং একটি পিছনের দিকে ঘোরানো। সামনের মুখটি দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এবং পিছনের মুখটি অতীতের দিকে ফেরানোকে নির্দেশ করে।জানুয়ারি প্রথম মাস হওয়ার পিছনে অতীত এবং ভবিষ্যৎ উভয় দিকে তাকানোর একটা সম্পর্ক আছে।

যে সব দেশে খ্রিস্টধর্মের আধিপত্য ছিল, তাঁরা ২৫ মার্চকে নতুন বছরের শুরু হিসাবে উদযাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ষোড়শ শতকে পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন এবং ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। উদ্দেশ্য, যীশু খ্রিস্টকে মহিমান্বিত করা।আমরা এখন যে ক্যালেন্ডার অনুসরণ করি সেটাই ‘গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। ইতালি স্পেন এবং পর্তুগালের মত ক্যাথলিক দেশগুলো দ্রুতই এই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে নেয়।

ইংল্যান্ড ১৭৫২ সালের আগ পর্যন্ত গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেনি। তাঁরা ২৫ মার্চকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে উদযাপন করত। সেই দিনটি নারী দিবস হিসাবে ও পালন করত। ব্রিটেনের পর ১৭৫৩ সালে সুইডেন, ১৮৭৩ সালে জাপান, ১৯১২ সালে চীন, ১৯১৮ সালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ইউরোপের সর্বশেষ দেশ হিসাবে গ্রীস ১৯২৩ সালে এই গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে।এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান প্রধান নয় এমন দেশও গ্ৰেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে।

জানুয়ারিকে প্রথম মাস হিসাবে গ্রহণ করার পিছনে রোমান প্রভাব ব্যাপকভাবে কাজ করেছিল। এটি কেবল সময়ের হিসাব রাখার একটি মাধ্যম নয়, মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অগ্রগতির প্রতিফলনও। জানুয়ারি দেবতা জানুসের মতোই আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে নতুন সূচনা করার অনুপ্রেরণা দেয়।