নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি:- এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পৌষ সংক্রান্তি। বাঙালির এই উৎসব মানেই পিঠে-পুলির মহোৎসব। নতুন গুড়ের গন্ধ আর পিঠে-পুলির অতুলনীয় স্বাদে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। কিন্তু বলাগড় গ্রামে গেলে এই উৎসবের আমেজ আরও বেড়ে যায়। সেখানে গেলে আপনি হয়তো একটু থমকে যেতে পারেন, কারণ গ্রামে ঢুকলেই শুনতে পাবেন ধুপধাপ শব্দ। চারিদিকে শোনা যাচ্ছে এখন ধুপধাপ আওয়াজ। হ্যাঁ,ঠিকই শুনেছেন। এটা হল ঢেঁকির শব্দ। এখানেই গুঁডো করা হচ্ছে নতুন গোবিন্দভোগ আতপ চাল থেকে শুরু করে সিদ্ধ চাল। পিঠে-পুলির প্রতিটি কামড়ে মিশে থাকে ঢেঁকির এই তাল। বলাগড় গ্রামে গিয়ে দেখবেন, গ্রামের মানুষ মিলেমিশে এই ঢেঁকিতে চাল ভাঙছে। এই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তৈরী পিঠে-পুলির স্বাদ যেন আলাদা এক অনুভূতি এনে দেয় সকলের মনের মাঝে।
শীতের দিনে গ্রামে গেলেই কানে ভেসে আসতো ঢেঁকির ধুপধাপ আওয়াজ। দিনভর চলত চাল কোটার কাজ। আর সেই চালের গুঁড়ো দিয়েই তৈরী হত নানা রকমের পিঠে। কিন্তু আজকাল সেই দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। তবে হুগলীর রুকেশপুর গ্রামে এখনও ঢেঁকির আওয়াজ শোনা যায়। হুগলির বলাগড়ের রুকেশপুর গ্রামে আঙুর সাঁতরার বাড়িতে প্রায় ৬০-৬৫ বছর ধরে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। পৌষ সংক্রান্তির দিনগুলোতে গোটা গ্রামে যেন একটা উৎসবের আমেজ চলে। গ্রামের মহিলারা একইসঙ্গে বসে ঢেঁকিতে চাল কুটে নানা রকমের পিঠে তৈরী করেন।
ঢেঁকি পাতার কাজ শুরু হয় সংক্রান্তির একসপ্তাহ আগে। প্রথমে ঢেঁকিকে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। তারপর ঢেঁকির নীচে কাঠের ছোট ছোট ‘পুয়া’ বসানো হয়। ঢেঁকির সামনের অংশে একটি লোহার গোলাকার ‘গড়’ বসানো হয়, যার নিচে থাকে পাথরের তৈরী মজবুত বেদি। গড়ের চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়, যাতে চাল সহজেই গুঁড়ো হয়ে যায়। চাল গুঁড়ো করতে প্রথমেই চাল ভিজিয়ে নরম করা হয়। এরপর ঢেঁকির অপরপ্রান্তে পা দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। ঢেঁকির সামনের অংশ নীচে নেমে এসে চাল গুঁড়ো করে ফেলে। গুঁড়ো চাল, চালুনিতে ছেঁকে নেওয়া হয়, আর এই গুঁড়ো থেকেই তৈরী হয় ঐতিহ্যবাহী পিঠে। মেশিনে ভাঙা চালের গুড়ির তুলনায় ঢেঁকির চালের গুড়ি দিয়ে তৈরী পিঠের স্বাদ যেন আরও বেশি পরিপূর্ণ। আঙুর সাঁতরা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ঢেঁকির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন, তিনি জানান, “সারা বছর ঢেঁকি এক পাশে রাখা থাকে, কিন্তু পৌষ সংক্রান্তি এলেই সেটি আবার ব্যবহার করা হয়। আমাদের এই ঢেঁকিটি প্রায় ৬০-৬৫ বছরের পুরনো। এটি আমার শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া। পৌষ সংক্রান্তি এলেই গ্রামের অনেক মহিলা একত্রিত হয়ে ঢেঁকিতে চাল ভাঙতে আসেন আমাদের বাড়িতে। চাল ভাঙার এই কাজটি শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি আসলে একটি আনন্দঘন সামাজিক মিলন। গল্প আর হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে সবাই একসঙ্গে চাল ভাঙে।”
ঢেঁকিতে ভাঙা চাল দিয়ে তৈরী পিঠের স্বাদ মেশিনে ভাঙা চালের চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু। বিশেষ করে সরা পিঠে কিংবা পুলি পিঠের মতো ঐতিহ্যবাহী পিঠে তৈরীতে ঢেঁকির চালের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেশিনে ভাঙা চাল দিয়ে পিঠের সেই বিশেষ গুণাগুণ ও স্বাদ পাওয়া যায় না।
পূর্ণিমা প্রামানিক স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ছোটবেলায় দেখতাম সারারাত ধরে ঢেঁকিতে চাল ভাঙা হতো। গ্রামের বিভিন্ন পাড়া থেকে মানুষ এসে লাইন দিত ঢেঁকির কাছে। তখন ঢেঁকি বন্ধ হত না। এখন সেই দিনগুলো বদলে গিয়েছে। আধুনিক যন্ত্র আর শরীরের সমস্যার কারণে অনেকেই ঢেঁকির পরিবর্তে মেশিন ব্যবহার করেন।” আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছুই বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি যেন হারিয়ে যাওয়া একটি শব্দ। বলাগড়ের রুকেশপুর গ্রামের সাঁতরা বাড়ি এই ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে। সংক্রান্তির এই সময় ঢেঁকির ধুপধাপ আওয়াজে মেতে ওঠেন গোটা গ্রামের সকলেই। মহিলারা দল বেঁধে এসে হাসি-গল্পের মধ্যেই চাল ভাঙেন। আর এই ঐতিহ্যই গ্রামবাংলার সনাতন সংস্কৃতিকে জীবন্ত করে রাখে।