ঐতিহ্য বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ এবারের পৌষমেলার

আন্তর্জাতিক কলকাতা জেলা দেশ রাজনীতি রাজ্য শহর

নিজস্ব প্রতিনিধি, শান্তিনিকেতন: মেলা যা প্রতিটি আপামর বাঙালির ছোট থেকে বড় সকলের কাছেই সমান আকর্ষণীয়। মেলা মানেই মেলবন্ধন। সেখানে পৌষমেলা প্রতিটি বাঙালির কাছে এক অন্য আবেগ। এই পৌষমেলার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন দেশ – বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।

আজকের এই শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার কিন্তু সূচনা হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এই মেলাকে শান্তিনিকেতনে তুলে নিয়ে আসেন। প্রথমদিকে, এই মেলা হত মাত্র একদিনের। একদিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষেরা আসতেন তাঁদের পসরা নিয়ে। পরে গুরুদেব দেখলেন এই মেলা একদিনের হলে মানুষজন ঠিকমতো উপভোগ করতেই পারেন না। তারপর থেকেই এই মেলাকে তিনদিনে আকার দিলেন খোদ গুরুদেব নিজেই। তারপর থেকে এই পৌষমেলা এতোদিন হয়ে এসেছে তিনদিনের| আর এবার হবে ছয়দিনের।
ধীরে ধীরে এই মেলার নাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন জেলা, রাজ্য সহ বিভিন্ন দেশের থেকে মানুষজন আসতে শুরু করেন এই মেলায়, তবে শুধুমাত্র মেলা পর্যবেক্ষণ করতে নয়, মেলায় আসতেন বিভিন্ন দেশ-বিদেশের হস্তশিল্পীরাও। মেলার ক’দিন কবিগান থেকে শুরু করে লোকগান, বাউল, কীর্তন, ছৌ- নাচ সবকিছু মিলে একেবারে জমে উঠতো এই পৌষমেলা। এই মেলার আরেক অন্যতম আকর্ষণ ছিল কাশ্মীরি শালের দোকান ছিল। মানে আপনি শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় গিয়েছেন আর কাশ্মীরী শালের দোকান দেখতে পাননি এটা হতেই পারে না। ওরাও সারাবছর তাকিয়ে বসে থাকতো কবে আসবে এই পৌষমেলা। ঠিক গুটিগুটি পায়ে সময় হলেই তাঁরা এসে হাজির হতেন এই বিখ্যাত পৌষমেলার মাঠে।


২০১৯ সাল পর্যন্ত রমরমিয়ে চলেছে এই মেলা। তবে তার পরেই ছেদ পড়েছিল এই মেলার, কারণ সেই করোনা। যদিও এই মহামারী কেটে যাওয়ার পর চেনা ছন্দে ফিরেছে সকলেই, একমাত্র ফেরেনি এই পৌষমেলা। এবার ২০১৯ সালের পর আগের মতোই পূর্বপল্লীর মাঠে ফিরছে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের উৎসব পৌষমেলা। রীতি মেনেই এই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে ৬ পৌষ রাতে বৈতালিকের মধ্যে দিয়েই।

ইউনেস্কো থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এবছর অনেকেরই আশা ছিল এবার হয়তো পৌষমেলা আরও বড় করে করা হবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার ছন্দ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেলার কোনো সূচিই এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি। আর এই নিয়েই তৈরি হয়েছে ধন্দ্ব, যার জেরেই রাজ্যের সব জেলা থেকে শুরু করে দেশের সব রাজ্য বা নেপাল, ভূটান সহ পার্শ্ববর্তী দেশের মানুষেরা তাঁদের পসরা নিয়ে আসবেন কিনা তা নিয়ে সকলের মধ্য়েই এক বড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ তাঁরা এখনও পর্যন্ত জানেন না কোথায় কিভাবে যোগাযোগ করবেন।

অন্যদিকে, পৌষমেলা এবার এতো বছর পর বিশ্বভারতীর দ্বারা পরিচালিত হলেও তাতে যে গুরুদেবের আদর্শ থাকবে না তা একরকম পরিস্কার হয়ে দিয়েছে। গুরুদেব কখনও কোনদিন ব্যবসা চাননি, কিন্তু আজ পৌষমেলার আসল উদ্দেশ্যই হয়ে গিয়েছে ব্যবসা। তাই আদর্শ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধনকে কতটা ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবার বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেটাই এখন বড়় প্রশ্ন।

তবে শান্তিনিকেতনের প্রবীণ আশ্রমিকদের বক্তব্যও খুব পরিস্কার। প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রীয় ঠাকুর জানান, পৌষমেলা হোক তার চেনা ছন্দেই, সেই মেলা যেন নিজের আঙ্গিক, ঐতিহ্য, আদর্শ থেকে বেড়িয়ে গিয়ে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতির আর ঐতিহ্যের ওপর কোনও কলঙ্কের দাগ লাগাতে না পারে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই এবারের পৌষমেলা একদিকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ অন্যদিকে, রাজ্য প্রশাসনের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। আদপে মেলা কর্তৃপক্ষ কি গুরুদেবের আদর্শ আর ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সক্ষম হবে?