মৃত্যুর আগে নির্যাতিতার উপর কী হয়েছিল? সিবিআইয়ের রিপোর্টে চমক

অপরাধ আইন কলকাতা

নিজস্ব প্রতিনিধি, কোলকাতা: কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক টিম ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ‘এমআইএমবি’ আরজিকর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সিবিআই এর প্রশ্নের উত্তরে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছে তাতে বলা হয়েছে এই ঘটনা একজনের পক্ষেই ঘটানো সম্ভব। নির্যাতিতার দেহ থেকে যে লালারস উদ্ধার হয়েছে তা ধৃত ব্যক্তি সঞ্জয় রায়ের। নির্যাতিতার শরীর থেকে মেলেনি বীর্যও।

কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের নির্যাতিতা চিকিৎসক পড়ুয়ার মৃত্যু মামলায় নতুন তথ্য সামনে এসেছে। এই ঘটনার তদন্তে গতি আনতে সিবিআই একটি বিশেষজ্ঞ দল, মেডিক্যাল ইনভেস্টিগেশন মনিটরিং বোর্ড (এমআইএমবি) গঠন করে। এই দলকে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট সহ অন্যান্য নথি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।সিবিআই মোট নয়টি প্রশ্ন করে এই ঘটনার সত্যতা খুঁজতে চায়। এমআইএমবি তাদের প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য সিবিআইকে জানিয়েছে। উল্লেখ্য, নির্যাতিতার দেহ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পুলিশ মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রাইকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সিবিআই কেন্দ্রীয় ফরেনসিকের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সঞ্জয় রাইয়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। এরপর ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই তার বিচারপর্ব শুরু হয়, যা এখন শেষের দিকে। নির্যাতিতার মৃত্যুর কারণ ও সময় সম্পর্কে জানতে চায় সিবিআই। এমআইএমবি-র উত্তর অনুযায়ী, নির্যাতিতাকে শ্বাসরোধ করে এবং গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু হয় ৮ আগস্ট রাত বারোটা থেকে ৯ আগস্ট সকাল ৬টার মধ্যে।সিবিআই আরও জানতে চায়, নির্যাতিতার উপর কী ধরনের যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল। ছবি ও ভিডিও পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, দু’ভাবে তাঁর যৌনাঙ্গের হাইমেন ছিঁড়ে গিয়েছিল। রক্তাক্ত দেহরস উদ্ধার করা হয়েছিল। চোয়ালের কাছে আঘাতের চিহ্ন ও গলার কাছে যে চিহ্নটি দেখা গিয়েছিল, সেটি ‘লাভ বাইট’ চিহ্ন বলে পরিচিত। নির্যাতিতার দেহের উপরের অংশ থেকে লালারস সংগ্রহ করা হয়। তার ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, গত ২১ আগস্ট যে ডিএনএ রিপোর্ট সিবিআইয়ের হাতে এসেছে, তাতে উল্লেখ ছিল যে, ওই লালারস সঞ্জয় রাইয়ের।

সিবিআই প্রথমে জানতে চেয়েছিল, নির্যাতিতার শরীরে পাওয়া আঘাতগুলি একজন ব্যক্তির দ্বারা করা সম্ভব কি না। ‘এমআইএমবি’ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, নির্যাতিতার মুখ, গলা এবং যৌনাঙ্গে পাওয়া আঘাতগুলি দেখে এটি স্পষ্ট যে, এই আঘাতগুলি একজন ব্যক্তির দ্বারা করা হয়েছে। সিবিআই এরপর মৃত্যুর আগে নির্যাতিতার শরীরে কী ধরনের আঘাত ছিল এবং সেগুলি কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। ‘এমআইএমবি’ জানিয়েছে যে, নির্যাতিতার শরীরে পাওয়া প্রত্যেকটি আঘাতই মৃত্যুর আগে সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রমাগত শ্বাসরোধের ফলে তার চোখ রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। জোরে চেপে ধরার কারণে তার গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। নির্যাতিতার বাঁচার চেষ্টার ফলে তার শরীরে আরও অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। তার নাক ভেঙে যাওয়ার কারণে নাকেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। যৌনাঙ্গে জোর করে কোনও কিছু প্রবেশ করানোর ফলে সেখানে দুই ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। ‘এমআইএমবি’ আরও জানিয়েছে যে, যখন নির্যাতিতা বাধা দিয়েছিল, তখন তাকে ভোঁতা বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আঘাতগুলি সঞ্জয় নামক অভিযুক্ত ব্যক্তির শক্ত হাতের কারণে হতে পারে।

সিবিআই যখন ধর্ষণের এই ঘটনা তদন্ত করে, তখন তারা প্রমাণ হিসেবে নির্যাতিতার শরীরে বীর্য বা সিমেনের চিহ্ন খোঁজে। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, ধর্ষণ হয়েছে বলে অভিযোগ থাকলেও নির্যাতিতার শরীরে বীর্যের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। তখন প্রশ্ন ওঠে, কেন?এই ধরনের একটি ঘটনায় সিবিআই যখন তদন্ত করেছিল, তখন তারা একদল বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করেছিল। এই বিশেষজ্ঞদের দলের নাম ‘এমআইএমবি’। এমআইএমবি সিবিআইকে জানিয়েছে যে, অনেক কারণে নির্যাতিতার শরীরে বীর্য না পাওয়া যেতে পারে।

যদি ধর্ষণকারী কোনো কন্ডোম বা অন্য কোনো বস্তু ব্যবহার করে, তাহলে নির্যাতিতার শরীরে বীর্যের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। যদি ধর্ষণকারী তার যৌনাঙ্গ ব্যবহার না করে অন্য কোনো কিছু ব্যবহার করে, তাহলেও নির্যাতিতার শরীরে বীর্যের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কখনো কখনো ধর্ষণকারীর শরীরে বীর্যের পরিমাণ এত কম থাকতে পারে যে, নির্যাতিতার শরীরে তার চিহ্ন পাওয়া নাও যেতে পারে। ধর্ষণের পর যত বেশি সময় যাবে, নির্যাতিতার শরীরে বীর্যের চিহ্ন পাওয়া তত কঠিন হয়ে পড়বে।

সিবিআই তদন্ত করে জানতে পেরেছে যে, ধর্ষণকারী ধর্ষণের সময় কোনো কন্ডোম ব্যবহার করেনি। সিবিআই আরও জানতে পেরেছে যে, ধর্ষণকারী অন্য উপায়ে যৌন নির্যাতন করেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ময়নাতদন্তের সময় ঘরে অতিরিক্ত ব্যক্তির উপস্থিতি নজরে এসেছে, যা নিয়ম বহির্ভূত। নির্যাতিতার দাঁতে ব্রেস থাকার কারণে মুখের ভিতর বেশি সংখ্যক আঘাত দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।