নিজস্ব প্রতিনিধি,কলকাতা ও সন্দেশখালি : মাত্র বাইশ বছরেই নাট্যমঞ্চকে বিদায় জানিয়েছিলেন বিনোদিনী। কিন্তু স্টার থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর নাম আজও ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এবার সেই নটী বিনোদিনীকে সম্মান জানাতে বিশেষ ঘোষণা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সোমবার সন্দেশখালি থেকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, স্টার থিয়েটারের নাম বদলে বিনোদিনী থিয়েটার হবে।
নটী বিনোদিনীর সঙ্গে স্টার থিয়েটারের নাম আজও জড়িয়ে রয়েছে। বিডন স্ট্রিটে স্টার থিয়েটার গড়ার সময় নটী বিনোদিনীর অনুরোধে গুর্মুখ রায় নামে এক বিত্তশালী ব্যক্তি ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাতে। কিন্তু সেই সময়কার মানুষ বিনোদিনীর নামে কোনও প্রেক্ষাগৃহ যে মেনে নেবে না, তা স্পষ্ট বুঝেছিলেন নির্মাতারা। এরপরেই সেই প্রেক্ষাগৃহের নাম হয় স্টার থিয়েটার। সেই মঞ্চ গড়তে অনেক কিছু বাজি রেখেছিলেন বিনোদিনী। কিন্তু পাননি যোগ্য সম্মান।
১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই স্টারের মঞ্চে যান বিনোদিনী। শোনা যায়, গুর্মুখ তাঁর অর্ধেক স্বত্ব বিনোদিনীকে একসময় দিতে চাইলেও তা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি স্টারের নিজের অংশ ৪ জনকে বিক্রি করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বিনোদিনী অভিনীত ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকটি দেখে তাঁকে আশীর্বাদ করেন বলে কথিত রয়েছে। ১৮৮৬ মাসে ২৩ বছর বয়সে রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করেন বিনোদিনী। ১৯৪১ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় তাঁর।
২০০৪ সালে স্টার থিয়েটার নতুন করে নির্মাণের সময় নাট্যপ্রযোজক গণেশ মুখোপাধ্যায় এই প্রেক্ষাগৃহের নাম বিনোদিনী রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নটী বিনোদিনীকে সম্মান জানিয়ে এবার স্টারের নাম ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ রাখার কথা ঘোষণা করলেন।
স্টার থিয়েটারের নাম বদল করে বিনোদিনী থিয়েটারের নামে করা হবে বলে সন্দেশখালির সভা থেকে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরেই তৎপরতা শুরু কলকাতা পৌরসংস্থার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেন মেয়র পরিষদ হেরিটেজ বিভাগ স্বপন সমাদ্দার। তাঁর দাবি স্টার থিয়েটারের নাম আসলে নটী বিনোদিনী নামের নামকরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ফলে তাঁর নামের বদলে স্টার থিয়েটার নামকরণ করা হয়েছিল।
মেয়র পারিষদ হেরিটেজ বিভাগ স্বপন সমাদ্দার জানান, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণায় আমরা খুশি। তিনি তাঁর ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নেতৃত্বে কলকাতা পৌরসংস্থার হেরিটেজ কনজারভেন্সি কমিশনের নামকরণের সুপারিশের পর মেয়র পারিষদ বৈঠকে এবং তার পর কলকাতা পৌরসংস্থার মাসিক অধিবেশনে স্টার থিয়েটারের নাম বিনোদিনী থিয়েটার নামের প্রস্তাব পাস করা হবে।’
তার পরেই নাম পরিবর্তনের পদ্ধতিগত কর্মকাণ্ড শুরু হবে বলে জানালেন মেয়র পরিষদ হেরিটেজ বিভাগ স্বপন সমাদ্দার। প্রসঙ্গত, নটী বিনোদিনী সমাজের সকল স্তরের মানুষই তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর প্রশংসকদের তালিকায় ছিলেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, ফাদার লাঁফো, এডুইন আরনল্ড, কর্ণেল অলকট প্রমুখ। রামকৃষ্ণদেব তাঁর চৈতন্যলীলার অভিনয় দেখে তাঁকে গ্রীনরুমে গিয়ে চৈতন্য হোক বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে বিনোদিনীর মধ্যে দিয়ে সফলভাবে গড়ে উঠতে দেখেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর বহু প্রশংসা করেছিলেন। বিনোদিনীর ত্যাগ স্বীকারে যে নতুন থিয়েটার তৈরি হয় বিনোদিনীর নাম তাতে থাকেনি। এই নতুন থিয়েটারের নাম হয় স্টার থিয়েটার। এই বিশ্বাসঘাতকতায় যখন বিনোদিনী দুঃখে বেদনায় মন ভেঙে পড়ে। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ২২-২৩ বছর বয়সে তিনি রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে যান। তারপর দীর্ঘদিন জীবিত থাকলেও কখনও অভিনয়ে ফিরে আসেননি। ফলে বাংলা থিয়েটার বঞ্চিত হয় এক অসামান্য অভিনেত্রীর প্রতিভা এবং অভিনয় থেকে।
যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ার পর থেকে বারবার জীবনের নানা মুহূর্তে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন নটী বিনোদিনী। ১৮৮৩ সালে ৬৮ বিডন স্ট্রিটে নির্মিত হল থিয়েটার ভবন। কথা ছিল, বিনোদিনীর নাম অনুসারে তাঁর নাম হবে বিনোদিনী থিয়েটার, কিন্তু গিরিশচন্দ্র ও অন্য পুরুষ অভিনেতাদের চক্রান্তে থিয়েটারটি ‘স্টার থিয়েটার’ নামে রেজিস্ট্রি হল। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলেন বিনোদিনী। কিন্তু আজকের থিয়েটার জগতে তাঁরা অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্টার থিয়েটারের নাম বিনোদিনী থিয়েটার করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সমস্ত স্তরের মানুষ। আজকেই স্টার থিয়েটারের নাম তুলে দিয়ে বিনোদিনী থিয়েটারের বোর্ড লাগানো হয়েছে। মেয়রের লিখিত অনুমতিও পাওয়া গেছে।