নিউজ পোল ডেস্ক: বছর ভোর আমাদের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব-নিকেশ চলে। বছর শেষে এসেও জীবন খাতার পাতায় আমরা চোখ রাখি কী পেলাম আর কি হারালম। সে সবের স্মৃতিচারণ চলে মনের মণিকোঠায়। একটা বছরে কত কিছুই না বদলে যায়। চোখের পলকে কেটে যায় দিন। অতীত হতে চলা ২০২৪ সালের সেই আলো-অন্ধকার এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী আমাদের দেশ। যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে ভূ-ভারত। সেই সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলির স্মরণে আজ নিউজ পোল।
রামমন্দির উদ্বোধন: বছরের শুরুতেই গেরুয়া ঝড়ের সাক্ষী হয় ভারতবাসী থেকে বিশ্ববাসী। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট যে রামমন্দির নির্মাণের সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ২০২৪-এর ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের মন্দিরের উদ্বোধন করেন তিনি। এই মন্দিরটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির। যার মূল নকশা ১৯৮৮ সালে আহমেদাবাদের আশিস সোমপুরা তৈরি করেন। ঐতিহ্যবাহী নাগারার আদলে (উত্তর ভারতের মন্দির শৈলী) তৈরি করা হয় অযোধ্যার এই রামমন্দির। পূর্ব-পশ্চিমে রামমন্দিরের দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট, চওড়া ২৫০ ফুট, উচ্চতা ১৬১ ফুট। অযোধ্যার রামমন্দিরে মোট ৩৯২টি পিলার এবং ৪৪টি দরজা রয়েছে। ২.৭ একর জমিতে রামমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি রিপোর্ট অনুসারে, রামমন্দির নির্মাণে খরচ হয়েছে মোট ১৮০০ কোটি টাকা। ৮ ফুটের রামলালার মূর্তি নির্মাণ করেন ভাষ্কর অরুণ যোগীরাজ। রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের উপস্থিতিতে ধুমধাম করে রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়। রামমন্দির উদ্বোধনে মোট খরচ হয় ১০০ কোটি টাকা। যদিও বিরোধীরা দাবি করেন, ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে তড়িঘড়ি রামমন্দির উদ্বোধন করছে মোদী সরকার। উন্নয়নের বদলে মন্দির নির্মাণকে সামনে রেখে লোকসভা নির্বাচনে জয় চাইছে তাঁরা।
লোকসভা নির্বাচন: রামমন্দির উদ্বোধনের ঠিক ২ মাস পরে ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভা নির্বাচন শুরু হয় ১৯ এপ্রিল এবং শেষ হয় ১ জুন। মোট সাত দফায় নির্বাচন হয়। এর ফল প্রকাশিত হয় ৪ জুন। ৫৪৩ জন সংসদীয় প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করেন প্রায় ৯৬ কোটি ভোটার। শাসক শিবির NDAজোট ৪০০ পারের স্লোগান দিলেও ২৯৫ আসনে থামে বিজয়রথ। বিজেপি জেতে ২৪০ আসনে। যদিও বিরোধী পক্ষ দাবি করেছিল, রামমন্দির উদ্বোধনের জোরে ও পাকিস্তান বিরোধী হিন্দুত্বের জিগির তুলে বিজেপি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবে। কিন্তু বিরোধী ইন্ডিয়া জোট জিতে নেয় ২৩০টি আসন। কংগ্রেস একা ৯৯ আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শক্তি বিজেপিকে উড়িয়ে ২৯টি আসনে জয় ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি তথা NDA জোটের আসন সংখ্যা বিগত লোকসভা ভোটের তুলনায় কমলেও জোট সঙ্গীদের কাঁধে ভর করে ‘ম্যাজিক ফিগার’ ২৭২ আসন ডিঙিয়ে যাওয়ায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরে গেরুয়া শিবির। প্রধামন্ত্রীর পদে হ্যাট্রিক করেন নরেন্দ্র মোদী।
আরজি কর কাণ্ড : ৯ আগস্ট, ২০২৪ অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন ভারতবাসীর কাছে। আরজি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত এক জুনিয়র ডাক্তার ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল হয় দেশ। ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান ওঠে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও। তদন্তে নেমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ মূল অভিযুক্ত হিসেবে সঞ্জয় রাই নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে। পরে আদালতের নির্দেশে তদন্তভার যায় CBI এর হাতে। আদালতে ধৃত সঞ্জয়ের বিরুদ্ধেই চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। বর্তমানে শিয়ালদহ আদালতে সেই মামলা চলছে। খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার পুলিশ অফিসার অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়। এমন একটা নৃশংস ঘটনায় দেশের শীর্ষ আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মামলাটি গ্রহণ করে। অন্যদিকে, সহকর্মীর সুবিচারের দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ প্রায় একমাস কর্মবিরতি পালন করেন। তার সঙ্গে চলে অনশনও। শেষমেষ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কাজে ফেরেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা।পরে সিবিআইকে দেওয়া রিপোর্টে সিএফএসএল জানিয়েছেন, সেদিন নাকি সেমিনার রুমে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্নই মেলেনি! তাই সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলকে জামিন দেওয়া হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের মামলা চলছে। তাই জেল মুক্তি হয়নি। তবে আন্দোলন পুরোপুরি নিভে যায়নি। বছর শেষেও বিচারের আশায় দিন গুনছেন ‘অভয়া’র বাবা-মা।
ভারতীয় ফুটবলের যুগাবসান – সুনীল ছেত্রীর অবসর :৬ জুন, ২০২৪ এই তারিখটি এদেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষদের কাছে অত্যন্ত মনখারাপের দিন। ভারতীয় ফুটবলকে নতুন স্বপ্ন দেখানো তারকা আচমকাই অবসর ঘোষণা করেছিলেন ৪০ বছরের সুনীল ছেত্রী। ৬ জুন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শেষবারের মতো তাঁকে জাতীয় দলের অধিনায়কের জার্সিতে দেখা গিয়েছিল। চল্লিশেও মাঠজুড়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ালেন তারকা স্ট্রাইকার। ভারতের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা, আন্তর্জাতিক স্তরে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, দেশের হয়ে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা – সুনীলের ঝুলিতে রয়েছে এসব ঈর্ষণীয় রেকর্ড। জাতীয় দলের হয়ে মোট ১৫১ টি ম্যাচে তাঁর গোলের সংখ্যা ৯৪। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে বাইচুং ভুটিয়ার পর শতাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ডধারী সুনীলই। ছুঁয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানও। এহেন খেলোয়াড়ের বিদায়বেলার বেদনা ছুঁয়ে রইল ২০২৪-কে।
এক দেশ এক ভোট : ২০২৩ সালে ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে কমিটি গঠিত হলেও চলতি বছরে ২৪ ডিসেম্বর পেশ করেছে মোদী সরকার। গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বৈঠকে এক দেশ এক ভোট সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট অনুমোদিত হয়েছিল। ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে একসঙ্গে লোকসভা এবং সবকটি বিধানসভার নির্বাচন করানোর সুপারিশ করে আট খণ্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার রিপোর্টটি জমা দিয়েছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কমিটি। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের মাঝেই গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘এক দেশ এক ভোট’ সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট অনুমোদিত হয়। ১৭ ডিসেম্বর লোকসভায় সংসদে পেশ হয় এক দেশ, এক ভোট বিল। যদিও বিল পাশ হয়নি। সেটিকে পাঠানো হয়েছে যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসিতে। ‘এক দেশ, এক ভোটে’র মতোই চলতি বছরে অভিন্ন দেওয়নি বিধি নিয়েও সরগরম সংসদ। একদিকে যখন শাসকদল দেশের সকল নাগরিকদের জন্য ধর্মনিরেপক্ষ আইন আনতে বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে বিরোধী গোষ্ঠীর বক্তব্য- সংখ্যালঘুদের চাপে ফেলতেই এই আইন আনতে চাইছে মোদী সরকার। অন্যদিকে ২০২৪-এর ৮ আগস্ট সংসদে পেশ হলেও জেপিসিতে আটকে রয়েছে ওয়াকফ বিল।