বানীপুর লোকউৎসব

জেলা রাজ্য সংস্কৃতি

সৌমিতা মণ্ডল, হাবড়া: লোকউৎসব গ্রামবাংলার মানুষদের কাছে প্রিয় একটি উৎসব। প্রাচীনকালে নৃত্যগীতের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে এই অনুষ্ঠান পালিত হত। কিন্তু বর্তমানে এই লোকউৎসব এক অন্যমাত্রায় পৌঁছেছে। শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত, এটি পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম লোকউৎসব মেলা। ঠিক এরপরেই রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম লোকউৎসব মেলা হল উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার বানীপুর মেলা। ২০২৫এ ৩ জানুয়ারী শুরু হয় এই মেলা যা চলবে ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত।

এই লোকউৎসব ঘিরে বানীপুরবাসীদের মধ্যে এক আলাদাই উন্মাদনা থাকে। বানীপুরের মানুষজন সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে এই মেলার জন্য। ৩ জানুয়ারী এই মেলার উদ্বোধন হয় এক আড়ম্বরপূর্ণ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। এই শোভাযাত্রায় নানা জেলা থেকে শিল্পীরা উপস্থিত হয়ে তাঁদের কার্যক্রম দেখান। উদ্ভোদনের দিন উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী কাকলি ঘোষ দস্তিদার সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

বানীপুরের লোকউৎসবের আকর্ষণগুলি হল –
প্রতি বছরের মতো এবছরেও মানুষের বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে বিশেষ প্রদর্শনীকে ঘিরে। প্রদর্শনীতে বানীপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকার স্কুলগুলি থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের বানানো বিভিন্ন মডেল নিয়ে উপস্থিত হয়। এছাড়াও থাকে বৃহৎ আকৃতির সবজি ও ফলমূল। এর সঙ্গে থাকে শান্তিপুরের শিল্পীদের বানানো সামগ্রী। যা দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এই মেলাতে মূল মঞ্চ সহ একধিক মঞ্চ রয়েছে। সেই মঞ্চগুলিতে প্রতিদিনই রয়েছে নানা ধরণের অনুষ্ঠান, যেমন – নাচ, গান, কবিতা, কীর্তন ছাড়াও একাধিক অনুষ্ঠান। এক এক দিন বিশিষ্ট শিল্পীরা উপস্থিত হন।

বাংলার লোকসংস্কৃতি ও রাজ্যের নানা জায়গার শিল্পের সম্ভার নিয়ে এই মেলায় হাজির হন বিক্রেতারা। খুঁটিনাটি জিনিস থেকে ঘর সাজানো সামগ্রী, বাঁশের তৈরী নানান হাতের তৈরি জিনিস। এইজন্যই সাধারণ মানুষদের কাছে এক বাড়তি গুরুত্ব এনে দেয় এই লোকউৎসব। এই মেলায় দেখা যায় ছোট থেকে বড়ো সকলের জন্য বিভিন্ন ধরণের রাইডস। এর সঙ্গে বিশেষ আকর্ষণ থাকে মরণ কূপের খেলা যা বাছা থেকে বড়ো সকলকেই শিহরণ জাগায়।

বাঙালিদের খাচ্ছে খাওয়া-দাওয়া এক অন্যতম বিষয়। আর বাংলার মেলা মানে বিভিন্ন খাবারের সম্ভার। মথুরা কেক থেকে শুরু করে মিষ্টি, পিঠে-পুলি, চাইনিজ আইটেম সহ অনেক কিছুই মিলবে এই মেলায়।

চলুন জেনে নেওয়া যাক বানীপুর লোকউৎসবের এই ইতিহাস —

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এত বড়ো আর প্রাচীন মেলা আর নেই।২০২৫ সালে ৬৯ বছরে পদার্পন করল। জানা যায় স্বাধীনতার পূর্বেই কৃষি ও ব্যবসা কেন্দ্রিক মেলা হিসেবে বানীপুর মেলার সূচনা হয়েছিল। প্রথম দিকে স্থানীয় কৃষকরা এই মেলার মাধ্যমে তাঁদের উৎপন্ন শস্য ও পালিত গবাদি পশু বেচাকেনা করতেন। শীতকালে একটি নির্দিষ্ট দিনে এই মেলা অনুষ্ঠিত হত। এছাড়া এই সময় মেলায় বলদ দৌড়, কীর্তন, যাত্রাপালা ইত্যাদি প্রকিত ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৫৬ সালে বানীপুর পিজিবিটির গান্ধী ময়দানে মেলার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এই মেলার সূচনা করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায়। তিনি বানীপুর মেলাকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে তিনি শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার অনুকরণে বানীপুর মেলা সূচনা করেন। তবে প্রথমের দিকে আজকের মত এত জমজমাট ছিল না। তখন এই মেলা ১ দিন হত। প্রত্যেক বছর ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হত। ৮০র দশকের শেষ পর্যন্ত এই রীতি বজায় ছিল। বানীপুরের আশেপাশের স্কুলগুলিতে কর্মশিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হত। তাদের বানানো বিভিন্ন সামগ্রী এই মেলায় প্রদর্শন করা হত।

ক্রমে এই মেলা বানীপুর মানুষদের কাছে প্রাণ সঞ্চার করে। তাঁদের বানানো বেতের ঝুড়ি, ধামা বিভিন্ন জিনিস, পড়া মাটির পুতুল, পুঁতির জিনিস ইত্যাদি। এছাড়া পিঠে পুলি, মিষ্টান্ন, জিলিপি, পাঁপরের দোকানের সমাবেশে জমে উঠতো বানীপুর মেলা। তখনকার দিলেও বিভিন্ন জেলা থেকে লোকশিল্পীরা আসতেন এই মেলায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, রিত্তিক ঘটক, অন্নদাশঙ্কর রায়ের মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন । প্রথমদিকে সরকারি আর্থিক সয়াহতায় এই মেলা চলতো কিন্তু ৮০র দশকে তা বন্ধ হয় যায়। এই সময় আর্থিক কারণে বেশ কয়েক বছর এই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে নতুনভাবে কোনোরকম সরকারি উদ্যোগ ছাড়াই স্থানীয়দের উদ্যোগে এই মেলার প্রচলন হয়। সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা এই মেলার নেতৃত্ব দেন। এই মেলা ১ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩ দিন ক্রমে ৭ দিনে রূপান্তরিত হয়। ২০০০ সালের পর থেকে মেলার আকার ও পরিসর অনেক বৃদ্ধি পায়। ২০২১-২০২২ সালে করোনা পরিস্তিতির কারণে এই মেলা বন্ধ থাকলেও ২০২৩ সালে এই মেলা আবার চালু হয়। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে এক মাস পরে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমানে ডিসেম্বরের বদলে জানুয়ারীতে এই মেলা আয়োজিত হয়। এই বছর ৩ জানুয়ারী থেকে ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত চলবে এই মেলা।