নিজস্ব প্রতিনিধি: মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিষাক্ত স্যালাইন ব্যবহারের অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হয়েছে জনস্বার্থ মামলা। মামলার শুনানিতে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্য সচিব ও পরিবার কল্যাণ দফতরকে ঘটনার উপর বিস্তারিত কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্র সরকারকেও রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রাজ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। আগামী ৩০ জানুয়ারি রাজ্য সরকারকে এই বিষয় একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপরেই হবে মামলার পরবর্তী শুনানি।
প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষন- মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতির মৃত্যুতে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে রিঙ্গার ল্যাক্টেট সলিউশনের ব্যবহারের কারণেই ওই প্রসূতির মৃত্যু ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর, ১১ ও ১২ নম্বর রেস্পন্ডেন্টকে কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ওই দপ্তরকে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার উভয়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে, হারানো জীবন ফিরে আনা সম্ভব নয়। রাজ্য প্রশাসন জানায় যে, নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহারের কারণে এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঘটেছে এবং মৃতদের পরিবারের সহায়তার জন্য প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। কর্ণাটক সরকার ২২ মার্চ, ২০২৪ তারিখে ১২ নম্বর রেস্পন্ডেন্টকে ব্ল্যাকলিস্ট করেছে এবং অন্যান্য রাজ্যগুলিকেও নোটিশ পাঠানো হয়েছে।এছাড়া, মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে একটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য, যেখানে ওই ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ ব্যাখ্যা করা হবে। কেন্দ্রকেও একটি রিপোর্ট প্রদান করতে হবে। অভিযুক্ত সংস্থাকে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে এবং পরে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত জানান, ‘১৪ জানুয়ারি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা জারি করে জানায়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজ্য যেন কোন নতুন ওষুধ ব্যবহার না করে। সিআইডির দ্বারা এই ঘটনার তদন্ত চলছে।’ প্রধান বিচারপতি আদালতে প্রশ্ন তোলেন, ‘প্রায় ১০ দিনের বেশি কেন দেরি করা হল এই ওষুধ প্রত্যাহার করতে?’ তিনি বলেন, ‘যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হত তাহলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না।’ রাজদীপ মজুমদার, কেন্দ্রের আইনজীবী জানান, ‘এরইমধ্যে ওই কোম্পানিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং স্যালাইনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তিনি বলেন, আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবাদপত্রে দেখলাম এরইমধ্যে সিআইডি কোম্পানিকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জানান, ১৩ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে। তবে প্রধান বিচারপতি ফার্মা কোম্পানির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত জানান, তিনটি ব্যাচে স্যালাইন এসেছিল, ৩০ হাজার বোতল রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। এসব বোতল ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে এবং মুম্বাইয়ের ল্যাবেও পাঠানো হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। মেদিনীপুর হাসপাতালে পাঁচজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। বাকিরা এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মামলাকারী আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি বলেন, ‘২০১৫ সালে গাইনোক্লোজিস্ট চিকিৎসক (উদয়ন মিত্র) এর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয় এবং বাধ্য হয়ে ওই চিকিৎসক পদত্যাগ করেন। ২০২৪ সালের ২ মার্চ কর্ণাটক সরকার একটি বিশেষ স্যালাইন কোম্পানিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ, ওই স্যালাইনের ব্যবহার কর্ণাটকে একাধিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপর কর্ণাটক সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য রাজ্যগুলিকে বিষয়টি জানিয়ে সতর্ক করে। কর্ণাটকে স্যালাইনের কারণে রোগীদের সমস্যা তৈরি হওয়ায় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে তদন্তও শুরু হয়। তবে, পশ্চিমবঙ্গে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়। জনস্বার্থ মামলার জেরে রাজ্যে এই স্যালাইন নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হলেও তা আগে কেন কার্যকর করা হয়নি?’ ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগ কন্ট্রোলার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই স্যালাইনের বিক্রি ও ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে। রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব কেন নির্দেশ কার্যকর করেননি, তা নিয়ে এরইমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
স্যালাইন কোম্পানির আইনজীবী অভ্রজিৎ মিত্র বলেন, ‘কর্ণাটক সরকার স্যালাইন কোম্পানিকে ব্যান করার পর আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল এবং সেটি এখন বিচারাধীন রয়েছে কর্ণাটক হাইকোর্টে।’ অপর মামলাকারী আইনজীবী তরুণ জ্যোতি তেওয়ারি বলেন, ‘এই স্যালাইনের দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।’ রাজ্যের আইনজীবী জানান, রিঙ্গার ল্যাকটেট স্যালাইন বহুল ব্যবহৃত একটি ওষুধ এবং তিনি নিজেও এই স্যালাইন ব্যবহার করেছেন। রাজ্য এই স্যালাইন এক্সপায়ার হয়ে যাওয়ার আর ব্যবহার করেনি। একই কোম্পানি অন্যান্য রাজ্যে, যেমন- আসাম, বিহার, ত্রিপুরা, তামিলনাড়ুতে স্যালাইন ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত রাজ্যে এই স্যালাইন ব্যবহারের কারণে পাঁচজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনাদের আগে থেকেই স্যালাইন বন্ধ বা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আপনারা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যের আইনজীবী জানান, অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।