নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি : সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরপরেই বলাগড় তথা হুগলিতে গঙ্গার ভাঙন নিয়ে সরব হয়েছিলেন রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়।তার জেরেই কেন্দ্রীয় গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল বলাগড়ের গুপ্তিপাড়ায় এসে পৌঁছায়। গঙ্গা ভাঙন পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেবেন তারা। গুপ্তিপাড়া ফেরিঘাট লাগোয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বৈঠক করেন তাঁরা। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়,সদর মহকুমা শাসক স্মিতা সান্যাল শুক্লা,বিডিও বলাগড় সুপর্না বিশ্বাস,জেলা পরিষদ পঞ্চায়েত সমিতির ও গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা।
হুগলির সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গা ভাঙন নিয়ে লোকসভায় বলেছিলেন। বলাগড় ব্লকের শুধু না হুগলি জেলার একটা বড় সমস্যা হল গঙ্গা ভাঙন। এর জেরেই বৃহস্পতিবার গঙ্গার বন্যা প্রতিরোধ কমিশনের প্রতিনিধি দল গঙ্গার ভাঙন দেখতে হুগলির বলাগড় ও চন্দননগর এলাকায় পৌঁছন। বিষয়টি রাজ্য সরকার ও হুগলি জেলা প্রশাসনকে কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে।গুপ্তিপাড়া,বলাগড়,জিরাট,ভবানীপুর,মিলনগড়, চরকৃষ্ণবাটি, খয়রামারি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা গঙ্গার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ। বাড়ি চাষের জমি স্কুল রাস্তা জলের তলায় গেছে। ভাঙন রোধ না হলে আরও ক্ষতির আশঙ্কা।
লঞ্চে করে ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদল।জিএফসিসির ডেপুটি ডিরেক্টর রঞ্জিত কুমার,এডি দীপক কুমার ও এডি রোশন কুমার পটনা থেকে আসেন।
ডেপুটি ডিরেক্টার রঞ্জিত কুমার বলেন, ‘আমরা গঙ্গার ভাঙন দেখতে এসেছি। সাংসদ এটা নিয়ে লোকসভায় বলেছিলেন। আমাদের দপ্তরে চিঠিও দিয়েছিলেন। তাই আমাদের চেয়ারম্যান আমাদের পাঠিয়েছেন এখানে। একটা রিপোর্ট তৈরি করব এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে।’
হুগলির সংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি যখন প্রচারে এসেছিলাম তখনই আমি দেখেছিলাম বিশাল এলাকা জুড়ে গঙ্গার ভাঙন। এটা এই এলাকার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা।গ্রামের মানুষ সর্বদাই দুশ্চিন্তায় থাকেন এই ভাঙনের নিয়ে। আমি এই বিষয় নিয়ে ওপর মহলের সঙ্গে কথা দিয়েছিলাম, যদি আমি সাংসদ হই তাহলে কিছু করার চেষ্টা করব।লোকসভায় আওয়াজ তুলব। এত তাড়াতাড়ি সাড়া পেয়েছি তাই ধন্যবাদ জানাই দিল্লীকে এবং আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে।আমি চেষ্টা করছি, দেখা যাক কতটা কি হয়।’ রাজ্য সেচ দফতরের আধিকারিকরা জানান, ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি বড়ো কাজ, তাই একটা পরিকল্পনা করে করতে হবে।’
রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে জোর চর্চা চলছে এই বিষয়টি নিয়ে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, এই জেলায় পাঁচ বছর বিজেপি সংসদ ছিলেন, কিন্তু গঙ্গা ভাঙন নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রচনা বন্দোপাধ্যায় সংসদে সরব হতেই কেন্দ্রীয় টিম পাঠানো হয়েছে। যা অভিনেত্রীর ‘রাজনৈতিক ওজন’ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও পদ্ম শিবির প্রকাশ্যে এই অভিযোগ অধিকার করেছেন।
কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের গঙ্গা ভাঙন পরিদর্শনের সংবাদে উচ্ছ্বসিত বলাগড়ের মানুষ। গুপ্তিপাড়ার ১ নম্বর পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান বিশ্বজিৎ নাগ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার কাজ কতটা করবে আমি জানি না। কিন্তু কেন্দ্রীয় টিমের সফরে এটা প্রমাণিত যে, বলাগড় ভাঙনের বাস্তবতা তাঁরা স্বীকার করেছেন। বর্তমান সংসদকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভায়া নেই।’ জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় দল চুঁচুড়ার সার্কিট হাউস থেকে সরসরি গুপ্তিপাড়া জেটিঘাটে যাবেন। সেখান থেকে চান্দরা, মিলনগড় হয়ে প্রতিনিধি দল চন্দননগর ও ভদ্রেশ্বরের গঙ্গাপাড়ের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে।
গঙ্গার ভাঙন কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা চাঁদরায় না এলে বোঝা যায় না।জমি ভিটেমাটি সব চলে গেছে গঙ্গার জলে। পিচে রাস্তা ভেঙে বাড়ির উঠোনে চলে এসেছে গঙ্গা। কখন অবশিষ্ট বাড়িটাও গঙ্গায় নেমে যায় সেই দুশ্চিন্তা নিয়েই দিন কাটে গ্রামবাসীদের।
সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে অবশেষে আজ বৃহস্পতিবার গঙ্গা ভাঙন দেখতে বলাগড়ে আসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল। গ্রামবাসীরা সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিলেন কতটা সমস্যার মধ্যে তাঁরা আছেন সেটাকেই তাঁরা তুলে ধরবেন। কেন্দ্রীয় দল ও সাংসদের কাছে। সেটা করতে না পারায় দিনের শেষে তাই ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা জানিয়ে দিলেন আদৌ এই ভাঙন সমস্যা মিটবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তার।
বৃহস্পতিবার সকালে গুপ্তিপাড়া ফেরিঘাট থেকে লঞ্চে করে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন কেন্দ্রীয় দলের তিন সদস্য। ছিলেন জেলা প্রশাসনের আধিকারিক ও জনপ্রতিনিধিরা। রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা এলাকা পরিদর্শন করে থেকে সেখান থেকে বেরিয়ে যান তাঁর নিজের কর্মসূচিতে। বলাগড়ের স্কুল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। অন্যদিকে, বলাগড়ের সব থেকে বেশি ভাঙন-কবলিত এলাকার চাঁদরার মানুষ অপেক্ষায় থাকেন কখন আসবে কেন্দ্রীয় দল সাংসদ। সাংসদ আসছেন না দেখে কয়েকজন গ্রামবাসী বলাগড় পঞ্চায়েতে পৌঁছে যান। এদিকে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের লঞ্চ গঙ্গা বক্ষ দিয়ে বলাগড় থেকে জিরাটের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
গ্রামবাসীরা জানান, গত তিন মাসে গঙ্গার ভাঙন ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। এলাকার দোতলা বাড়ি গঙ্গার তলিয়ে গেছে। চাষের জমিও চলে গেছে এইভাবে চলতে থাকলে তাদের শেষ অবলম্বনটুকুও ভিটেটাও হারাতে হবে।
চাঁদরা গ্রামের বাসিন্দা রজত হালদার বলেন, আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি। ভাঙন এমন আকার নিয়েছে আগামী দিনে বাড়িঘর বাঁচানো যাবে কিনা সেটাই চিন্তার। শুনেছিলাম আজকে কেন্দ্রীয় দল আসছে। তাই আমরা সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু দেখলাম গঙ্গা দিয়ে তাদের লঞ্চ চলে গেলো।
আগে বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধ করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু ভাঙনে তা তলিয়ে যায়। কংক্রিট বা পাথরের বোল্ডার ফেলে পাকাপাকিভাবে এই ভাঙনকে আটকানোর চেষ্টা না করলে চাঁদরা গ্রামটাই হয়তো একদিন ম্যাপ থেকে মুছে যাবে।
বলাগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নবীন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘সাংসদের চাঁদরায় যাবার কথা ছিল না। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা যারা এসেছেন তাঁরা গঙ্গা বক্ষে লঞ্চে করে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করছেন। সেখান থেকেই তাঁরা বিষয়টা বুঝছেন। গ্রামবাসীরা যেটা বলছেন সেটা ঠিক নয়, তাঁদের কাছে কোন ভুল বার্তা গেছে। আমরা চাই বলাগড়ের ভাঙন সমস্যা মিটুক। তার জন্য সাংসদ উদ্যোগী হয়েছেন।’
সাংসদ রচনা বলেন, ‘আমি আগের বারে এসেছিলাম বলে এবারে আর গেলাম না। কেন্দ্রীয় দলের কাছে সমস্ত পেপার দেওয়া আছে। তাঁরা গিয়ে সব কিছু তত্ত্বাবধান করবেন। সাংসদ চেয়েছিলেন বলে আজকে সেচ দফতর এসেছে। ওপর থেকে ভাঙন দেখা যায় না তাই বোটে করে পরিদর্শন করেছেন।’