‘ঐক্যের মহাযজ্ঞ’ মহাকুম্ভে

আন্তর্জাতিক ইতিহাস দেশ

নিউজ পোল ব্যুরো:- উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের গঙ্গা-যমুনা-স্বরসতীর ত্রিবেণী সঙ্গমে ১৩ জানুয়ারী সোমবার থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে মহাকুম্ভ মেলা। সেখানে একত্রিত হয়েছেন অনেক পুণ্যার্থীরা। কোটি কোটি ভক্তের আরাধনায় ত্রিবেণী তীর্থ এখন ভারত-তীর্থে পরিণত হয়েছে। যেখানে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ যেমন – আমেরিকা,ইংল্যন্ড,আয়ারল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া,স্পেন,ব্রাজিল,ইটালি, পর্তুগাল,জাপান থেকে শুরু করে বিশ্বর বহু দেশ। সকলের কাছেই এখন একটাই কথা “মেরা ভারত মহান”। কুম্ভমেলার আয়োজন, আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া সর্বোপরি উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই মহান যজ্ঞের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ সকলেই। শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগের জন্য নয়, যাঁরা পর্যটনের টানে ভারতে এসেছেন, তাঁদের কাছেও মহাকুম্ভ এক অন্যরকম আবেগ। তাঁদের কথায়, এখানেই ভারতের রূপ-বৈচিত্রের আসল রূপ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা।

জানেন কি, এই কুম্ভমেলা কবে শুরু হয়েছিল? কুম্ভমেলা কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে এই মেলা যে কয়েকশো বছরের পুরনো তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু দার্শনিক ও সাধু আদি শংকরাচার্য ভারত জুড়ে মঠ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সমাবেশ করেন। মনে করা হয় সেই সময়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল কুম্ভমেলা। যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, ঊনিশ শতকের আগে এত বড় ধর্মীয় সমাবেশের প্রমান পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদদের মতে, স্বাধীনতার আগে এই কুম্ভ মেলার আয়োজন করত ব্রিটিশ সরকার। সেইসময় শুধুমাত্র কুম্ভমেলার খুঁটিনাটি ও সুরক্ষার দিকগুলি দেখার জন্য ইংল্যান্ড থেকে জেনারেল অফিসার আসতেন এই মেলার আয়োজন তদারকি করার জন্য। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজে প্রথম আয়োজন হয়েছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভমেলা। এই মেলার তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ। সেই বছর কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছিল ১২ কোটি মানুষ।

২০২৫-এ কুম্ভমেলা হল বিশ্বের সবথেকে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ। যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, বলে দাবি এক বিদেশিনীর। এক রাশিয়ান মহিলার কথায়, ‘মেরা ভারত মহান’। ভারত একটি মহান দেশ। ওই রাশিয়ান মহিলা বলেন, ‘আমরা প্রয়াগরাজের কুম্ভমেলায় প্রথমবার এসেছি। এখানে আমরা আসল ভারতের ঐতিহ্য দেখতে পাচ্ছি – ভারতীয় মানুষের মধ্যে সত্যিকারের এক শক্তি আছে। এই পবিত্র স্থানে এই ধরণের পরিবেশে আমি শিহরিত। আমি ভারতকে ভালোবাসি।’

দক্ষিণ আফ্রিকার এক ভক্তও ভারতের সংস্কৃতি ও মানুষের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বলেন, “এখানে রাস্তা খুবই পরিষ্কার-পরিছন্ন, এখানে প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের বন্ধু। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এখানে আছেন এবং আমরা তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করছি। আমরা সনাতন ধর্ম পালন করি এবং এভাবেই মহাকুম্ভের এই শৃঙ্খলিত আয়োজনকে আমরা ভালোবাসি।”

অ্যারিজোনার সাধ্বী ভাগবতী সরস্বতী, ৩০ বছর ধরে ঋষিকেশের পরমার্থ নিকেতনে বসবাস করছেন। ২০২৫-এ মহাকুম্ভে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “এটি শুধু সঙ্গমে পুণ্যস্নান নয়। এটি মানুষের বিশ্বাস এবং ভক্তির মধ্যে এক পবিত্র স্নান। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির শক্তি এবং মহানতার উদাহরণ… এটি কোনও রক কনসার্ট বা ক্রীড়া ইভেন্ট নয়। এত বড় সংখ্যায় মানুষ কেন একত্রিত হয়েছে? তাঁদের বিশ্বাসের জন্য, তাঁদের ভক্তির জন্য।”

পোল্যান্ড থেকে এসেছেন ক্লদিয়া নামে এক পর্যটক। তিনি বলেন, ‘এই মেলা আমার কাছে খুবই স্পেশাল। এর আগে কখনও আমি এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারিনি।’ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে আগত এক পুণ্যার্থী বলেন, ‘কী সুন্দর এই পুণ্যস্নানের দৃশ্য ! রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানকার মানুষও কী সহজে আপন করে নেন। তাঁরা কত সুখী! আমরা সনাতন ধর্ম মেনে চলি।’ আবার এক স্প্যানিশ পুণ্যার্থী বলেন যে, ‘এখানে আমাদের প্রচুর বন্ধু রয়েছেন। তাঁরা স্পেন, ব্রাজিল, পর্তুগাল থেকে এসেছেন। আমরা তীর্থযাত্রায় এসেছি। আমি পুণ্যস্নান করেছি। খুবই উপভোগ করছি। এখানে এসে আমি খুবই সৌভাগ্যবান বলে নিজেকে মনে করছি।’

সোমবার ১৩ জানুয়ারী থেকে শুরু হওয়া মহাকুম্ভ মেলা চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত, হবে ৬টি পুণ্যস্নান। ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তকমা পাওয়া মহাকুম্ভ মেলাকে ঘিরে সাজসাজ রব। প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা আর পৌরাণিক সরস্বতীর সঙ্গমতটে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিকে ২৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার সিসি ক্যামেরা বসিয়ে চলছে নজরদারি। মহাকুম্ভে দেড় লক্ষ তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১২ কিলোমিটার অস্থায়ী ঘাট তৈরী করা হয়েছে যেখানে মানুষ স্নান করবেন। ৪০০ কিলোমিটার অস্থায়ী পায়ে চলার রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ২ লক্ষ ৬৯ হাজার বর্গমিটার এলাকা এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে মানুষের চলার ক্ষেত্রে কোনওরকম সমস্যা না হয়। এছাড়াও থাকছে আরও ব্যবস্থাপনা। ৩০টি অস্থায়ী সেতু তৈরী করা হয়েছে। ২০১টি রাস্তা, অলি-গলি চওড়া করা হয়েছে। ১৮০০ হেক্টর জমির উপর পার্কিং তৈরী করা হয়েছে। মহাকুম্ভে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য দেড় লক্ষ অস্থায়ী শৌচালয় তৈরী করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য ১৪৪টি চেঞ্জিং রুম তৈরি করা হয়েছে। ২৫ হাজার ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৫ হাজার সাফাই কর্মী টানা ৪৫ দিন কাজ করবেন। ৬৯ হাজার এলইডি সোলার লাইট লাগানো হয়েছে। এই সব কিছুই মুগ্ধ করেছে মেলায় আগত বিদেশি থেকে সকলকেই।

এই সময়ে নিজের ব্রহ্মচারী দশার কঠোর ত্যাগের পরে নাগা সাধু হওয়ার যোগ তৈরী হয়। অঘোরীরা বিশেষ যোগের সময় নানা ধরণের পুজো পাঠ ও সাধনা করে থাকেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, কুম্ভমেলায় ৪৫ দিন ধরে কল্পবাসের পর সাধনা করে পুণ্যলগ্নে পুণ্যস্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। তাই দেশ-বিদেশ থেকে সকলে অংশগ্রহণ করে এই মেলায়।