শুভম দে: আরে বাবা ক্রিকেটটা (Cricket) কি আর মেয়েদের (Women) খেলা? তা সে যতই বিসিসিআই (BCCI) একখানা উইমেন্স আইপিএল (WPL) করে ফেলুক না কেন। ভারতবর্ষ (India) তো আছে ভারতবর্ষেই। যেখানে বছরে কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যাটা দশ লক্ষ তো খাতায়-কলমে! শ্লীলতাহানি থেকে ধর্ষণ-খুন ঘটে আখছার! কিন্তু তারপরেও এদেশের মেয়েরা স্বপ্ন দেখে ডানা মেলার। উড়ে চলার। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (International Women’s Day) তেমনই এক নারীর স্বপ্নের উড়ানের গল্প নিউজ পোল বাংলায়।
জানুয়ারি, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম, মুম্বাই, ২০১৮।
আরব সাগরের তীরের শহরটাই শীত সেভাবে জাঁকিয়ে পড়েনা কখনোই। জানুয়ারির রোদ ঝলমলে সকালেও তাই বেশ গরম। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল পরের মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা উড়ে যাবে সিরিজ খেলতে। তার আগে কোচ তুষার আরোঠে স্কোয়াডের বেঞ্চ প্লেয়ারদের দেখে নিচ্ছেন। তারই প্র্যাক্টিস ম্যাচ চলছে। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের কিছু প্লেয়ার আর মুম্বাই অনূর্ধ্ব ষোলো দলের কিছু ছেলে মিলিয়ে একটা দল বনাম সিনিয়র ভারতীয় মহিলা দল (Indian Women’s Cricket Team)।
আরও পড়ুন: International Women’s Day: নারী দিবসে বিশেষ উদযাপন সল্টলেকে
একটা লম্বা-ডিঙডিঙে মেয়ে ব্যাট করছে। সদ্য ভারতীয় দলে ডাক পেয়েছে। উল্টোদিকে অনূর্ধ্ব ষোলো দলের ছেলেরা একের পর এক আউট হয়ে ফিরে গেলেও তাকে থামানো যাচ্ছে না। অভিজ্ঞ ঝুলন গোস্বামী থেকে শুরু করে সিনিয়র দলের অন্যান্য সব বোলারদের কাউকেই ছাড়ছেনা মেয়েটা। পরপর শট মেরেই চলেছে। বাউন্ডারি লাইন থেকে কোচ আরোঠে ডাক দিলেন, “জেমি!” হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ঝুলনরা। স্কোরার হিসেব করে বললো,”১১১ নট আউট ১০৩ বলে।” নেহাৎ কোচ থামতে বললেন নাহলে স্কোরটা আরো বাড়তো!

বাউন্ডারি লাইনের কাছে আসতেই কোচ আরোঠে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন, “ওয়েল প্লেড, জেমি!” এক হাতে হেলমেট আর অন্য হাতে ব্যাট নিয়ে একঝাঁক দাঁত বেড় করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটি। কে জানতো আগামী কয়েক বছরে মিতালী-হরমনপ্রীতদের পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম আইকন হয়ে উঠতে চলেছে এই মেয়ে?
আরও পড়ুন: Womens Day: শিল্পকলায় নারী, বিশেষ দিন উপলক্ষে বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন নারীদের
মুম্বাইয়ের ভান্ডুপ এলাকায় রডরিগেজ পরিবারের ছোটো মেয়েটির শুরু থেকেই খেলার দিকে ঝোঁক। পড়াশোনার থেকে ক্রিকেট ব্যাট বা হকি স্টিক হাতে দেখা যেত তাকে। শুধু ক্রিকেট আর হকিই নয়। বাস্কেটবল ও ফুটবলেও সমান ঝোঁক মেয়েটির। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে ফেলেছে সে। তাও আবার একটা নয়, দু-দুটো খেলায় — হকি আর ক্রিকেট। তা এ মেয়েকে কি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো বলা চলে?

আচ্ছা মহারাষ্ট্রের রাজধানী শহরটিকে ‘সিটি অফ ড্রিমস্’ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু আমরা যদি বলি ‘সিটি অফ লিজেন্ডস্’ অত্যুক্তি করা হবে কি? ভারতীয় ক্রিকেটকে কি দেয়নি বলিউডের ভরকেন্দ্র? সুনীল গাভাস্কার থেকে শুরু করে আজকের ‘হিটম্যান’ – আর এই লিস্টে ‘বড়া পাও’ -এর শহরের নতুন সংযোজন — ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অন্যতম ভরসা — জেমিমা রডরিগেজ (Jemimah Rodrigues)।
আরও পড়ুন: Sukanta Majumdar: পর্তুগাল থেকে গৃহবধূর মৃতদেহ ফিরল শান্তিপুরে
ইভান আর লাভিতা রডরিগেজের দুই ছেলের কোলে এক মেয়ে — এনখ, এলি আর জেমিমা। ছোট্ট জেমিমার ক্রিকেটে হাতেখড়ি শুরু মাত্র চার বছর বয়সে। বাড়ির মধ্যে চুপ করে বসে থাকতে পারতোনা ছটফটে মেয়েটি (Jemimah Rodrigues)। তাই বাবা ইভান রোজ দুই দাদার সাথে কুড়ি কিলোমিটার দূরে বান্দ্রার ক্রিকেট একাডেমিতে পাঠিয়ে দিতেন মেয়েকে। প্রথম প্রথম দুই দাদাকে বল করতো ছোট্ট জেমিমা। এভাবেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় তাঁর।
ভান্ডুপে ক্রিকেটের সেরকম সুযোগ-সুবিধা নেই তাই পরিবার নিয়ে, পারিবারিক ধর্মগুরু ম্যানুয়েলের পরামর্শে ভান্ডুপ ছেড়ে বান্দ্রায় চলে আসেন ইভান। কিন্তু সেখানে ছেলেদের সাথে একসঙ্গে খেলার সুযোগ না থাকায়, বাবার কথায় শিবাজী পার্কে প্র্যাক্টিস শুরু করেন জেমিমা। ইভান নিজে ক্লাব ক্রিকেটার ছিলেন একসময়। পরবর্তীকালে স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট কোচিং দিতে শুরু করেন। বান্দ্রায় এসে মেয়েকেও (Jemimah Rodrigues) ভর্তি করলেন সেই স্কুলে। এইসময় ব্রাদার ম্যানুয়েল একটি হকি স্টিক উপহার দেন জেমিমা কে। সেই প্রথম হকি স্টিক হাতে পাওয়া। নাহ্ ব্রাদার ম্যানুয়েলের সেই উপহারের মান রেখেছিলেন জেমিমা, মাত্র দশ বছর বয়সে মহারাষ্ট্র রাজ্য হকি টিমে নির্বাচিত হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সত্যিই ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী।

এর মাত্র দু’বছর পর মুম্বাই অনূর্ধ্ব উনিশ ক্রিকেট দলে সুযোগ পান জেমিমা (Jemimah Rodrigues)। কিন্তু বেছে নিতে হবে যেকোনো একটা। বাবা ক্রিকেট কোচ আর তাছাড়া আমাদের দেশে হকির থেকে ক্রিকেট অনেক বেশি জনপ্রিয়। হকির থেকে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সংখ্যাও বেশি। সারাবছর ধরেই খেলা যাবে। তাই সবকিছু ভেবেচিন্তে হকি স্টিকের বদলে ক্রিকেট ব্যাটটাই তুলে নেন জেমিমা। ভারতীয় হকি একজন দক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড (জেমিমার হকি পজিশন) হারালো বটে, কিন্তু আখেরে লাভ হল ভারতীয় ক্রিকেটের।
স্কুল ক্রিকেটে দারুণ পারফর্মেন্সের কারণে মুম্বাই অনূর্ধ্ব উনিশ দলে জায়গা পাকা করে নিতে দেরি হয়নি জেমিমার। আর সেই শুরু, মাত্র পনেরো বছর বয়সে চ্যালেঞ্জার ট্রফির দলে জায়গা করে নেওয়া থেকে মাত্র সতেরো বছর বয়সে মুম্বাই অনূর্ধ্ব উনিশ দলের অধিনায়কত্ব, জেমিমাকে (Jemimah Rodrigues) পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনো।

মুম্বাই অনূর্ধ্ব উনিশের হয়ে প্রথম মরশুমে (২০১৬-১৭) ৬৬৫ রান। পরের মরশুমে (২০১৭-১৮) ক্যাপ্টেন হয়েই দশটি ইনিংস খেলে করেন ১,০১৩ রান। গড় ১১২.৫৬! পাঁচটি সেঞ্চুরি ও একটি ডাবল সেঞ্চুরি। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই গুজরাটের বিপক্ষে ১৭৮ রান দিয়ে শুরু, পরের ম্যাচে সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে ২০২। স্মৃতি মান্ধনার পর দ্বিতীয় ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার হিসাবে ঘরোয়া ক্রিকেটে দ্বিশতরানকারী জেমিমা এরপর ডাক পান সফররত বাংলাদেশ দলের বিপক্ষে ইন্ডিয়া এ দলে। ইন্ডিয়া এ -র হয়েও নিজের দুরন্ত ফর্ম বজায় রাখেন তিনি এবং সিরিজ শেষ করেন তৃতীয় সর্বাধিক রানাধিকারী হিসাবে। ফলস্বরূপ ডাক পান জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে। এতদিনের কঠোর পরিশ্রম, হাড়ভাঙা অনুশীলন, ব্যাথা-যন্ত্রণা পরিণত হল সাফল্যে।
জেমিমাকে নিয়ে আইসিসির বিশেষ ভিডিও: https://www.icc-cricket.com/videos/jemimah-rodrigues-journey-icc-100-cricket-superstars
২০১৮ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি মাত্র সাতেরো বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে নীল জার্সি গায়ে পথ চলা শুরু হল জেমিমার (Jemimah Rodrigues)। সবার চোখ যখন মিতালী-মান্ধানা-হরমনপ্রীতদের দিকে, ঠিক তখন সাউথ আফ্রিকানদের কাছে আউট অফ সিলেবাসের মতো হাজির হলেন জেমিমা। আইডল মিতালী রাজের সাথে জুটি বেঁধে ২৭ বলে ৩৭ রান করে ভারতকে ম্যাচ জেতান তিনি। এরপর মার্চ মাসে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচে মাত্র ১ রানে আউট হয়ে গেলেও, এখনো অবধি ৪২টি ওয়ানডে ম্যাচে ২৯.৫৪ গড়ে ছয়টি অর্ধ-শতরান এবং একটি শতরান সহ ১০৯৩ রান করেছেন। সর্বোচ্চ ১০২। আর ১০৭টি টি-টোয়েন্টিতে ৩০.২২ গড়ে ১২টি অর্ধ-শতরান সহ তাঁর রানসংখ্যা ২২৬৭। সর্বোচ্চ ৭৬। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেট অভিষেকেও নজর কেড়েছেন জেমিমা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ড মহিলা দলের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকেই ৯৯ বলে ৬৮ রানের একটি অতি প্রয়োজনীয় ইনিংস খেলেন। এরপর নিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া মহিলা দলের বিপক্ষে ১২১ বলে ৭৩ রানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে দলকে প্রথম ইনিংসে লিড নিয়ে সাহায্য করেন। এখনও অবধি ৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৮.৭৫ গড়ে তিনটি অর্ধ-শতরানসহ তাঁর রান সংখ্যা ২৩৫। সর্বোচ্চ ৭৩। বল হাতে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ৬ টি উইকেটও আছে তাঁর।

ছোটোবেলায় একবার ব্যাটিং পাবার আশায় প্রায় ঘন্টা দুয়েক ফিল্ডিং করতে হত জেমিমাকে (Jemimah Rodrigues)। যা সাহায্য করেছে জেমিমাকে বর্তমান ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডার হয়ে উঠতে। অসাধারণ সব শটের পাশাপাশি দুর্দান্ত সব ক্যাচও ধরেন তিনি, যার সাক্ষী থেকেছে প্রোটিয়া অলরাউন্ডার মারিজান কাপ থেকে ইংল্যান্ডের কিয়া সুপার লিগ। নাহলে কি আর স্বয়ং জন্টি রোডসের থেকে প্রশংসিত হন!
ভারতীয় হকি দলের প্রাক্তন ফিল্ডিং কোচ জোয়াকিম কার্ভালহো একবার বলেছিলেন যে জেমিমা (Jemimah Rodrigues) ‘গড গিফ্টেড।’ তা খুব একটা ভুল কিছু বলেননি তিনি। ঠিকই চিনেছিলেন কার্ভালহো, এ মেয়ে সত্যিই গিফ্টেঢ! হকি স্টিক-ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি গিটার হাতেও সুর তুলতে সমান পারদর্শী জেমিমা। ক্রিকেট ট্যুরে যেখানেই যান, সাথে নিয়ে যান গিটারখানা। অবসর সময়ে সুর তোলেন তাতে। সবমিলিয়ে সত্যিকারের জিনিয়াস! ক্রিকেটের জন্য হকি ছাড়তে হয়েছে হয়তো। কিন্তু নিজের মনে এখনো একটা স্বপ্ন সযত্নে পালন করে চলেছেন জেমিমা — যদি কোনদিনও সুযোগ হয়তো হকির ময়দানেও দেশের হয়ে খেলতে চান তিনি।
আরও পড়ুন: WPL: মহিলা আইপিএলের প্রথম সুপার ওভারে আরসিবিকে হারাল ইউপি ওয়ারিয়র্জ
জেমিমাকে (Jemimah Rodrigues) জিজ্ঞাসা করুন তাঁর আইডল কে? বান্দ্রার তরুনীর থেকে আপনি শুনতে পাবেন রোহিত শর্মার নাম। ছোট থেকেই ‘হিটম্যান’ অনুপ্রেরণা জেমিমার। এই তো গত ২০২২ মহিলা বিশ্বকাপে নির্বাচকরা যখন তাঁকে বাদ দিয়ে দল গড়লেন তখন মুম্বাই তরুণী ভেবেছিলেন ক্রিকেট খেলাটাই ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর আইডল বোঝালেন তাঁকে যে এটাই জীবন। ২০১১ বিশ্বকাপের দলেও যে জায়গা হয়নি আজকের ভারতীয় অধিনায়কের! লড়াই করে ফিরেছিলেন তিনি। ফিরেছেন তাঁর অনুগামীও। ২০২৩ সালে মীরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে ব্যাট হাতে কেরিয়ার বেস্ট ৮৬ রানের ইনিংসটাই শুধু নয় বল হাতে অফস্পিন ভেলকিতে কেরিয়ারের সেরা মাত্র ৩ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট ঝুলিতে পুরে জবাব দিয়েছেন বঞ্চনার। সিরিজের প্রথম ম্যাচ হেরে দ্বিতীয় ম্যাচে দলকে ১০৮ রানের বিশাল জয় এনে দিয়ে সিরিজে সমতা ফিরিয়েছেন। হয়েছেন ম্যাচের সেরা। সাথে বোধহয় বুঝেছেন জীবনে লড়াইটুকুই সব। অদম্য লড়াইয়ে পিছু হঠে জীবনও আর এভাবেই ফিরিয়ে দেয় সবকিছু, সবটুকু।
নিউজ পোল বাংলা ফেসবুক পেজের লিংক: https://www.facebook.com/share/1EA79Afcw5/
আর আইডল শর্মাজীর মতো তাঁর নামের পাশেও একটা ডাবল সেঞ্চুরি আছে তো! কে জানে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও আমরা একটা ডাবল সেঞ্চুরি পাবোনা জেমিমার থেকে? সামনে অনেক পথ চলা বাকি আর জেমিমার ব্যাটিংয়েও তো দেখা যায় সেই ‘হিটম্যান’ -এরই ছায়া! এখন অবশ্য শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও তাঁর বাইশ গজ শাসন দেখতে চায় ভারতবাসী। ‘হিটওম্যান’ যে এখন অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছেন! আর ভারতীয় ক্রিকেটের ‘জেম’ হয়ে উঠছেন জেমিমা রডরিগেজ (Jemimah Rodrigues)।