নিউজপোল ব্যুরোঃ- আমাদের প্রত্যেকের শৈশব কাটে বাবা ও মায়ের শাসনের মধ্যে দিয়ে যেখানে থাকে একটি নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়াজাল। এমনই এক বালক যার সর্বদা বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গে দিন কেটে যেত মহলের দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরে। তাঁর দেখভালের জন্য থাকা এক ভৃত্য শ্যাম তাঁকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রেখে চারিদিকে গণ্ডি টেনে দিয়ে রামায়ণের গল্প শুনিয়ে বলতেন এই গণ্ডির বাইরে গেলে ভীষণ বিপদ। মন আছে তো সীতার কি হয়েছিল, বালকটি সেটি বিশ্বাসও করতেন। সে জানত এই গণ্ডি পেরিয়ে সীতা কতই না বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। অগত্যা বালকটি জানালার কাছে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে সারাদিন কাটাতো। বাইরে শান বাঁধানো ঘাট, এখানে প্রতিবেশীরা সারাদিন ধরে স্নান করত। একেক জনের স্নান করার ধরণ সে বসে বসে পর্যবেক্ষণ করত। সেই সময় সে একটি খাতা জোগাড় করে সেখানে তাঁর সমস্ত কল্পনা লিখে রাখত। তাঁর এই কল্পনাকৃত কবিতা তাঁর গৃহশিক্ষকের কাছে পৌঁছে যায়। তিনি এটি দেখে বিস্মিত হয়ে যান। এই বিস্ময়কর বালক আর কেউ নন তিনি ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১৮৬১ সালে, ৭ মে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী। তিনি ছেলেবেলায় ওরিয়েন্টাল মিশনারি স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনা করেন। কিন্তু বাড়ি ও স্কুলের এই পুঁথিগত শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ বন্দি জীবন তাঁর ভালো লাগেনি। তাই তাঁর গৃহ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানেই বাড়িতেই পঠন-পাঠন চলতে থাকে। কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কিছুই তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং ঠাকুর পরিবারের উন্নত চিন্তাভাবনা, মার্জিত সংস্কার ও পিতার অলৌকিক ধর্মবিশ্বাস প্রথিত হয়ে যায় কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনের মণিকোঠায়।
তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জমিদার, সেই সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। একদিন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে পৌঁছন শান্তিনিকেতনে|
রাতে পৌঁছে সেভাবে আর কিছু করা হয়ে ওঠেনি| পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই যখন সেই দৃশ্যকে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ তখন সেই মুহুর্তেইই ঠিক করে ফেললেন এখানেই গড়বেন তিনি মানুষ তৈরীর কারখানা| এরপর ধীরে ধীরে পিতার সঙ্গে দিন যেমন কেটেছে তেমনই পরিকল্পনাও থেমে থাকেনি| এরপর রায়পুরের জমিদারের থেকে মাত্র একটাকা মূল্যে বিশ বিঘা জমি কিনে সেখানেই শুরু করলেন পাঁচজন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়|
তিনি ঠিক করেছিলেন এখানেই তিনি প্রকৃতির মাঝে মানুষ তৈরীর কারখানা গড়ে তুলবেন। যেখানে থাকবে না কোনও নিয়ম শৃঙ্খলা, থাকবে না কোনও বেড়াজাল। প্রত্যেকটি মানুষ প্রকৃতির মাঝে থেকে প্রকৃতির থেকেই শিক্ষা উপলব্ধ করবে। যা পুঁথিগত শিক্ষার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না। সেই অনুযায়ী পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯০১ সালে যাত্রা শুরু হয় এই ‘ব্রহ্মচর্য্য’ বিদ্যালয়ের। এখানে প্রেম, প্রকৃতি, সৌন্দর্য্য, স্বদেশ, ধর্ম, উন্নত চিন্তাভাবনা প্রভৃতি একটি মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে। এই বিদ্যালয়েরই তিনি পরবর্তীতে নাম দেন ‘পাঠভবন’। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
জমিদারী সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। সেই সূত্রে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরকম একজন ব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম রথেনস্টিয়েন। রথেনস্টিয়েন তাঁর সঙ্গে কথা বলে অনুভব করেন, তিনি একজন অসামান্য ব্যক্তি। ফেরার পথে রথেনস্টিয়েন তাঁকে প্রস্তাবে জানায় পরবর্তী সময়ে দেখা হলে তাঁর পছন্দের কিছু নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ২-৩ বছর পরে পুনরায় যখন তাঁর পুরনো বন্ধু উইলিয়াম রথেনস্টিয়েনের সঙ্গে দেখা করতে যান তাঁর মনে পড়ে তাঁর পছন্দের কিছু নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা নিতেই ভুলে গিয়েছেন, তাই তিনি যাত্রাপথেই জাহাজে বসেই তাঁর সমস্ত কবিতা এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করেন। উইলিয়াম রথেনস্টিয়েনকে এটি উপহার দেন। যার নাম গীতাঞ্জলি| কিন্তু সমস্যা হয় রথেনস্টিয়েন বাংলা বোঝেন না, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুনরায় শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ফিরে আসেন। রথেনস্টিয়েন সেই লিপিবদ্ধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং সেটি সোজা নোবেল কমিটির কাছে পাঠান। ১৯১৩ সালে নোবেল কমিটি সেই লিপিবদ্ধ অর্থাৎ ‘গীতাঞ্জলী’ মনোনীত করে,যার ইংরেজি নাম হয় SONG OFFERINGS। আর এই বইটির জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান| এই নোবেল পুরস্কারের তৎকালীন পারিতোষিক ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবটাই আশ্রমের পরিকাঠামোতে খরচ করেন।
১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং ১৯২১ সালের, ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন এবং স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা পায়। এটি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দেশি ও বিদেশি সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের সেই শিক্ষাই দেওয়া হতে শুরু করে যা একদিকে তপোবনের শিক্ষা অন্যদিকে প্রকৃতির মাঝে থেকে শিক্ষা| আর এই দুইয়ের মাঝেই তৈরী হয় সত্যিকারের এক মানুষ তৈরীর কারখানা| খোলা আকাশের নীচে গাছের তলায় প্রকৃতির মাঝে ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে উঠতে শুরু করে|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর এই বিশ্বভারতীর দায়িত্ব কাঁধে পড়ে তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। নানা চড়াই-উতরাইয়ের সন্মুখীনের পর নয়া পালক বিশ্বভারতীর মূকুটে। শান্তিনিকেতন এখন থেকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান অর্থাৎ ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’, আর এই স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। বিশ্বে এই প্রথম একটি চালু বিশ্ববিদ্যালয় হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীতে ধারাবাহিক সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র হিসেবেই বিশ্বভারতী পেয়েছে এমন তকমা। শান্তিনিকেতন আশ্রম, বিশ্বভারতী সারা জীবনের আহরণ, সঞ্চয়ের আধার বলে মনে করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতীর যে ঐতিহ্য খোলা আকাশের নীচে শিক্ষা প্রদান করা সেটি এখনও জারি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে শিক্ষা তাঁর কাছে হার মেনে যায় খোদ ইউনেস্কো। বর্তমানে বিশ্বভারতীর জায়গা ১২৬৪ একর| ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি| চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কোর এক প্রতিনিধি দল শান্তিনিকেতনে এসে ঘুরে যায়| তখনই সৃষ্টি হয় নতুন সমস্যার| আসলে গুরুদেব কখনও কোনোদিন চাননি তাঁর সৃষ্টিকে কোনো বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে| তাই শান্তিনিকেতন ছিল সম্পূর্ণ খোলামেলা| বর্তমান বিশ্ববারতী কর্তৃপক্ষ গুরুদেবের সেই সৃষ্টিকে একেবারেই উঁচু পাঁচিল, কাঁটাতারের বেড়া আর বড় পেল্লাই সব গেট দিয়ে ঘিরে ফেলেছে| যা গুরুদেবের আদর্শের একেবারেই পরিপন্থি| তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র (বর্তমান) সুপ্রিয় ঠাকুর জানান, গুরুদেবের কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে না| কে বা কারা তাঁর জায়গাকে হেরিটেজ আখ্যা দিল তা নিয়ে গুরুদেবের কিছু এসে যায় না| গুরুদেব ও তাঁর শান্তিনিকেতন ছিল তার নিজের ছন্দে আর থাকবেও তার নিজের ছন্দে| কিছু মানুষ দিনের পর দিন এই জায়গাকে একদিকে কলুসিত করার চেষ্টা করে চলেছে,অন্যদিকে গুরুদেবের আদর্শকে একেবারেই শেষ করে দিতে চাইছে| এটা আমাদের সকলের লজ্জার| গুরুদেব যা সৃষ্টি করে গিয়েছেন আমাদের সকলের উচিত তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা|
শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনীদেরও একই কথা,শান্তিনিকেতনে আজ গুরুদেবের আদর্শকে কিছু মানুষ শেষ করার জন্য উঠে পড়ে নেমেছে| সকলের মনে রাখা উচিত এই গুরুদেবের জন্যই সকলে এখানে আসেন,কিন্তু সেটাই যদি শেষ হয়ে যায তাহলে যে সবকিছুই অচীরে একদিন শেষ হয়ে যাবে| আর ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদল এসে চারিদিককে ঘিরে ফেলতে চাইছে| কিন্তু যা বাস্তবে একেবারেই সম্ভব নয়| ফলে তাঁরা মানে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দল জানিয়েছে তাঁরা বিশ্বভারতীর সবজায়গাকে স্বীকৃতি দিতে পারবে না| কেবলমাত্র আশ্রম এলাকাটা সঙ্গে সঙ্গীত ভবন,কলাভবন ও তার সংলগ্ন এলাকাটাই তাঁরা হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবেন| একবার চিন্তা করে দেখুন,যে জায়গাকে সৃষ্টি করতে গিয়ে নিজের স্ত্রীর সোনার গয়না পর্যন্ত বিক্রী করে দিয়েছিলেন একদিন স্বয়ং গুরুদেব আর আজ কিছু মানুষ আদেকলার মতো হেরিটেজ তকমা পেতে গুরুদেবের সব নীতি আদর্শ থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি,প্রকৃতি,শিল্প সবকিছুকেই শেষ করে দিতে বসেছে| তবে কি জানেন তো, ওপরে একজন আছেন, আর তিনিই চান না এভাবে গুরুদেবের সবকিছুকে কেউ শেষ করে দিক| তাই এখন একদিকে ঐতিহ্য অন্যদিকে হেরিটেজ এই দুইয়ের লড়াইয়ের মধ্যে পড়েছে গুরুদেবের সারাজীবনের কর্মফল এই স্বপ্নের শান্তিনিকেতন| অপেক্ষা এখন শুধুই সময়ের আর অপেক্ষার| আদৌ কি এই হেরিটেজের তকমার প্রয়োজন ছিল বা আছে গুরুদেবের| খুব কি দরকার নতুন করে আবার এই জায়গাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার,অনেক আগেই তো বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতন এই তকমা পেয়ে গিয়েছে| তারপরেও যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য নিজের জীবনের পরিচয় পান আজ তাঁরাই কিনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হেরিটেজ তকমা দেবে| এই ধৃষ্টতার ফল একদিন ভোগ করতেই হবে| গুরুদেব নিজেই কখনও কোনোদিন এসব পছন্দই করতেন না| তাই আদপে সত্যিই কি হেরিটেজের তকমা দিয়ে গুরুদেবের আদর্শকে শেষ করে দেওয়া যাবে| শেষ কথা বলবে তো সময় কিন্তু সময়ের বেড়াজালে শেষ হয়ে যাবে না তো গুরুদেবের এই শান্তিনিকেতন|