নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা : ২০২৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে প্রথম ঐতিহাসিক প্রদর্শনী, যা ২৫০ বছরের পুরোনো হাতে খোদাই করা কাঠের খন্ড উন্মোচন করবে। এটি প্রথম একটি ঐতিহাসিক প্রদর্শনী যেটি বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠিত হবে, যা বাঙালিদের কাছে এক গর্বের বিষয়। এই ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে দেখানো কাঠের ব্লকগুলি হাতেই খোদাই করা হয়েছিল এবং আকারে সেন্টিমিটারের মতো অনেকটাই ছোট বলে জানা যায়। এই কাঠের ব্লকগুলি বিশ্বের সামনে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেছে।
উল্লেখ্য, বাংলা ‘টাইপোগ্রাফির জনক’ বলা হয় পঞ্চানন কর্মকারকে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ২২০ বছর পরে কাঠের খন্ড আবিষ্কার হয় যার মধ্যে রয়েছে শত শত ‘HARAF’ বা ব্লক তিনি খোদাই করেছিলেন যা সারা বিশ্বের কাছে উপহারস্বরূপ ছিল জানা যায়। পঞ্চানন কর্মকার ১৮০৪ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। শ্ৰীরামপুরে তাঁর বাড়িতে প্রায় দুই শতকের বেশি সময় ধরে মেশিনগুলিকে অদৃশ্যভাবে রাখা হয়েছিল যা বাংলা ভাষা মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত হত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় একটি সহজ সংস্করণ তৈরী করেন যা পরবর্তীকালে কর্মকারের তৈরী টাইপফেস ব্যবহার করা হয়েছিল। চার্লস উইলকিন্স একজন ইংরেজ টাইপোগ্রাফার এবং প্রাচ্যবিদ যিনি কর্মকারের কাজের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। উইলকিন্স প্রথম ‘ভগবৎ গীতা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্ম প্রথম প্রচলন করেছিলেন প্রাচ্যে। জানা যায় পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ভাষায় ছাড়া পরবর্তীকালে আরবি, ফার্সি, বার্মিজ, জাপানি এবং চীন সহ প্রায় ৪০টির বেশি ভাষায় টাইপফেস তৈরী করেছিলেন।
কর্মকারের কাজগুলি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দ্য গ্রামার অফ বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজে’ বইতে এবং বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পনে’ প্রথম ছাপানো হয়েছিল। টাইপিফেসের আবিষ্কারের ফলে বেশ কিছু স্থানীয় সংবাদপত্রের জন্ম হয়, যা বাংলার সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে। এমনকি এটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখে।
কর্মকার উইলিয়াম কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণ চাপানোর জন্য ভারতে প্রথম নাগরি টাইপ তৈরী করেছিলেন। এমনকি কর্মকারের সহায়তায় শ্রীরামপুর মিশন টাইপ তৈরী করার জন্য একটি ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি পরবর্তীকালে এশিয়ার বৃহত্তম টাইপ ফাউন্ড্রি হয়ে ওঠে। তাঁর এই অসামান্য অবদান বাংলা মুদ্রণে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। শুধুমাত্র মুদ্রণে নয় এটি শিক্ষা ও সাংবাদিকতার বিকাশের জন্য একটি বিশাল সুযোগ তৈরী করেছিল।
‘হারাফ’ নামক প্রদর্শনীটি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম কলকাতায় খোলা হবে এরপর সারা ভারত জুড়ে ভ্রমণ করবে। কর্মকারের নাতনি প্রিয়াঙ্কা মল্লিক যাঁর বয়স ২০ বছর তিনি মুম্বাইয়ের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস’ সাথে কাজ করেন। তিনি উত্তরিধিকারসূত্রে পেয়েছেন তাঁর মহান পিতামহের সমস্ত গুণাবলী যা ভারতসহ সারা বিষয়ে ঐতিহাসিকগত মূল্য অনেকখানি।
প্রিয়াঙ্কা মল্লিক বর্তমানে শ্রীরামপুরে তাদেঁর পৈতৃক বাড়িতে ফিরে এসেছেন এবং জানুয়ারিতে কলকাতায় প্রদর্শনী উন্মোচন করবেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত কর্মকার ততটা বিখ্যাত নন যতটা তাঁর হওয়া উচিত ছিল তিনি তাঁর যথাযথ স্থান পাননি। কর্মকার টাইপোগ্রাফির জনক বলে প্রসংশিত হলেও হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালি তাঁকে চেনেন।তিনি পরবর্তীতে ভারতীয় ভাষাগুলির পাশাপাশি আরবি, ফার্সি, বার্মিজ, জাপানি এবং চীনাসহ অন্যান্য ৪০টির বেশি ভাষা টাইপফেস তৈরী করেছিলেন। তাই তাঁর অবদান শুধু বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।যদিও এটা মনে হতে পারে যে তিনি কেবল একজন সুখ ভাস্কর ছিলেন, তাঁর বাংলা টাইপফেসের আবিষ্কার একটি গেম চেঞ্জার ছিল।’
তাহলে এখন প্রশ্ন হলো কি কি ঐতিহাসিক বস্তু এই প্রদর্শনীতে দেখানো হবে? মল্লিক বলেন, ‘আমি কর্মকারের উদ্ভাবন প্রদর্শন করবো – টাইপফেস তাঁর দ্বারা খোদাই করা বাংলা ধরণগুলি সমাচার দর্পনের একটি অনুলিপি, যা এশিয়াতে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। এশিয়াতে ছাপা প্রথম বইয়ের অনুলিপি। ‘A Grammar’ যা জোহানেস গুটেনবার্গ প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে নির্মিত। আমি বড় মেশিনের পাশাপাশি টাইপ ফাউন্ড্রীতে ব্যবহৃত খোদাই করা সরঞ্জামগুলিও গুলি দেখাবো যা পরে ব্রিটিশ সরকারের মুদ্রণের হার বাড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমানে উৎপাদন সক্ষম করার জন্য প্রেরণা দেয়। এছাড়া প্রদর্শনীতে হস্ত নির্মিত কাগজ এবং তালপাতার স্ক্রিপ্ট থাকবে। যে কাগজে মুদ্রণের আবির্ভাবের আগে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের জন্য ব্যাবহৃত হত। প্রদর্শনীতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে একটি হলো বাংলার মাদারবোর্ড যা ব্যবহার করা হয়েছিল আধার টাইপ ফাউন্ড্রীতে।
তিনি আরো যোগ করেন, ‘ আমি বিমান মল্লিকের একমাত্র কন্যা। এই মুহূর্তে একজন আইনি / স্বাভাবিক উত্ত্যরাধিকারী হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার ব্যাক্তিগত কোনো আশা নেই এবং ইতিহাস থেকে এটি হারিয়ে যাওয়া বাংলার জন্য এক বিরাট ক্ষতি। প্রত্নবস্তুগুলি প্রায় ২৫০ বছর পুরোনো এবং ক্রমাগত ক্ষয়িত হচ্ছে। যদি পরিবেশ এবং ট্যাবধানের অভাব থাকে তাহলে তা ভঙ্গুর হয়েও যেতে পারে।’
মল্লিক কর্মকারকে মরণোত্তর স্বীকৃতি দিতে চান যা তাঁর প্রাপ্য। মল্লিক বলেন, যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উইলিয়াম কেরি মতো উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিদের নাম স্বীকৃত হয় তাহলে পঞ্চানন কর্মকার এক বিশিষ্ট্য নাম। হেরিটেজ গোষ্ঠী, বাংলার সাহিত্যের অগ্রগামী সমর্থনের মাধ্যমে আমি কর্মকার বাংলায় একটি ঘরোয়া নাম করতে এবং সাংবাদিকতার পাঠক্রমে তাঁর ওপর একটি বিভাগ চালু করার লক্ষ্য নিয়েছি’।