নিজস্ব প্রতিনিধি, কোলকাতা: প্রতিবেশী দেশ ভূটান সরকার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বাংলার চিকিৎসা আর মানবিক প্রচেষ্টায় আবার প্রাণ ফিরে পেলেন বছর বত্রিশের ইয়াংকি। সন্তান জন্মানোর পর যাঁকে আর সজ্ঞানে দেখা যায়নি, তিনিই আজ আবার জীবন ফিরে পেয়েছেন। ইয়াংকি যখন শেষবার সজ্ঞানে ছিলেন, তখনও তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়নি। সন্তান তখনও মায়ের গর্ভে, নড়ছিল একটু একটু করে। কিন্তু সন্তানের জন্মের পরই শুরু হয় তাঁর অসহ্য মাথাব্যথা ও বমি। এরপর কী হয়েছিল, তা আর কিছুই মনে করতে পারেন না তিনি। এই অবস্থায় প্রতিবেশী দেশের সরকার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভুটানের তরুণী ইয়াংকি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাঁকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিবেশী দেশের চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে তাঁকে রাখা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, ইয়াংকি কোমায় চলে গিয়েছেন। নভেম্বর মাসে, দীর্ঘ ছয় মাস পর, ইয়াংকি কোমা থেকে ফিরে আসেন। তখন তাঁর সন্তানরা ছয় মাসের। ছয় মাসের এই দীর্ঘ যাত্রায় বাংলা তথা ভারতের মানুষ যে ভালোবাসা, সমর্থন এবং প্রার্থনা করেছেন, তা ইয়াংকি ও তাঁর স্বামীর জীবনে গভীর দাগ কেটে গেছে।
থান্ডার ড্রাগনের দেশ থেকে মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সায়েন্সে পৌঁছানোর দূরত্ব প্রায় ১০৪০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ যাত্রার স্মৃতি নেই ওয়াংচুর। কারণ, তিনি তখন কোমায় ছিলেন। জীবন্ত এক ‘লাশ’ হিসেবেই তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
প্রথমে তাঁকে ভর্তি করা হয় চিকিৎসক ডা. দেবজ্যোতি পাঠকের অধীনে। এরপর একটি বিশেষ টিম তৈরি করা হয়। সেই টিমে ছিলেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এস আনন্দ এবং ডা. চিরঞ্জীব দাস। ওয়াংচুর শরীর ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে শুরু করলেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। এই অবস্থায় তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ডা. সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাত ধরেই ওয়াংচু ফিরে পান নতুন জীবন। ডা. সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, ‘ভূটান দেশের চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিল যে ইয়াংকি কোমায় চলে গিয়েছেন। বেঁচে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই, মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু ইয়াংকির স্বামীকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে, কারণ তিনি কখনোই হাল ছাড়েননি।’
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সিদ্ধার্থ শঙ্কর আনন্দ জানিয়েছেন, ‘এখানে রোগী আসার পর আমরা একাধিক পরীক্ষা করি। এমআরআই, ইইজি, হাতে পায়ে স্নায়ুর পরীক্ষা করি, মেরুদণ্ডের পরীক্ষা করি। বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা ধারণা করেন যে, স্পাইনাল অ্যানাস্থেশিয়ার কিছু জটিলতার কারণেই এই অবস্থা হয়েছে। যদিও এই ধরনের ঘটনা খুবই বিরল। প্রথমে মহিলাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়, তারপর হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁকে ঘুম থেকে জাগানো। কোমা স্টিমুলেশন প্রোগ্রামও ব্যর্থ হয়।
এই পরিস্থিতিতে ডা. সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিভিন্ন জার্নাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এক অদ্ভুত ওষুধের কথা জানতে পারেন – জলপিডেম। সাধারণত ঘুমের সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের দেওয়া হয় এই ওষুধ। কিন্তু কোমাচ্ছন্ন রোগীর ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অস্বাভাবিক। ডাক্তারবাবু জানান, এই ওষুধের এক বিশেষ ধরনের প্রভাব রয়েছে, যা কিছু কিছু কোমাচ্ছন্ন রোগীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
একটি পরীক্ষার মতো, তিন দিন ধরে ১০ মিলিগ্রাম জলপিডেম দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও পরিবর্তন হয়নি। পরের তিন দিন ডোজ বাড়িয়ে ২০ মিলিগ্রাম করা হয়। এরপর আবার ১০ মিলিগ্রামে ফিরে আসা হয়। অবশেষে ১৪ জুলাই ইয়াংকি চোখ খোলেন। তারপর তাঁর মেয়ের ভিডিও দেখানো হয়, যা দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতি ফিরে আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইয়াংকি নিজের দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হন।