নিউজ পোল ব্যুরো : কলকাতা মহানগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হল শিয়ালদহ। হাওড়া স্টেশনের পাশাপাশি এই স্টেশনের গুরুত্ব অনন্য। কিন্তু শিয়ালদহ নাম শুনলে আমাদের মনে ভেসে ওঠে দমবন্ধ করা ভিড়। বিশেষ করে অফিসের সময় হলে তো কোন কথা নেই। কলকাতা তথা সারা ভারতে সবচেয়ে ব্যস্ততম ও গুরুপত্বপূর্ণ স্টেশনের মধ্যে অন্যতম একটি স্টেশন। স্টেশন কর্তৃপক্ষের দাবি বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বা ১৮ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করেন। সম্প্রতি শিয়ালদহ স্টেশন ‘কনফারেন্স অফ ইন্ডিয়ান গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল’ কর্তৃক গোল্ড সার্টিফিকেট পেয়েছে। গ্রিন স্টেশনের ধারণা নিয়ে তৈরি বাংলার পূর্ব রেলের শিয়ালদহ স্টেশন গোল্ড সার্টিফিকেট অর্জন করল। স্টেশনের নকশা, পরিকাঠামো ও কার্যপ্রণালী বিভিন্ন দিক বিচার করে এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। যাত্রীদের বিশ্রামস্থান, প্রবেশ-প্রস্থান পথ, টিকিট কাউন্টার, জল সংরক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শক্তি সংরক্ষণ সহ একাধিক বিষয় দেখা হয় ‘ইন্ডিয়ান গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের’ তরফ থেকে। শিয়ালদহ স্টেশনের নাম কিভাবে হল তা কি জানেন? চলুন সেই বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক ——–
১৭৫৭ সালে পরাজিত হয় সিরাজ-উদ-দৌলা, এর ফলে বাংলা চলে যায় ইংরেজদের কাছে। এরপর বাংলার নবাব হন মীরজাফর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৮ সালে মীরজাফরের কাছ থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে ৫৫টি গ্রাম কিনে নেয়। এই ৫৫টি গ্রামকে একসঙ্গে বলা হতো ‘ডিঙি ৫৫’। এর মধ্যে শিয়ালদহ, বেলিয়াঘাটার মতো গুরুপত্বপূর্ণ গ্রামগুলি ছিল। এই শিয়ালদহের পূর্বনাম ছিল ‘শৃগাল দ্বীপ’। এই নামের পিছনে একটি কারণ ছিল। ব্রিটিশদের অধীনে আসার আগে এই জায়গাটি ছিল জঙ্গলে ভর্তি ও তারসঙ্গে শিয়ালের ডাক শোনা যেত সন্ধ্যে হলেই। তৎকালীন ফ্রেডারিক উইলিয়াম স্টিভেন্স তৎকালীন ভারতের গভর্নর ছিলেন। গভর্নর পদে বসার পর তিনি লর্ড শিয়ালদহ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর নামানুসারে এই জায়গাটির নাম হয় শিয়ালদহ। কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ১৮৫৭ সালে তৈরী হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। তখন ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। স্বাভাবিকভাবে কলকাতা ছিল একটি গুরুপত্বপূর্ণ শহর।
ব্রিটিশদের কলকাতায় এমন একটা জায়গায় স্টেশনটি তৈরী করতে হবে যেখান থেকে সহজেই সব জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। ইস্টার্ন রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের মতে, শিয়ালদহের অবস্থান ছিল সবচেয়ে সুবিধাজনক। তখন শিয়ালদহ অঞ্চলটি ছিল জল ও কাদায় পরিপূর্ণ। সেটি ভরাট করে রেল লাইন পাতার জন্য দমদম পর্যন্ত গর্ত খুঁড়ে শক্ত ভীত বানানো হল। সেই রেল লাইন বানানোর দায়িত্ব পড়েছিল ‘কলকাতা এন্ড সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানি’। অবশেষে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া (বর্তমান বাংলাদেশে) পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়। তখন শিয়ালদহ স্টেশন ছিল কাঁচা ছাউনির ছাড়তে প্লাটফর্ম। ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকায় ১৮৬৯ সালে প্রযুক্তিবিদ ওয়াল্টার ক্র্যানভিলের নকশায় শিয়ালদহের মেইন বিভাগের পাকা স্টেশন বানানো হয়।
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে শুরু হওয়া শিয়ালদহ স্টেশন ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে যাত্রী পরিষেবা দিয়ে চলেছে। ক্রমে বেড়েছে প্লাটফর্ম, এরসঙ্গে বেড়েছে যাত্রী ও ট্রেনের সংখ্যা। আজকের এই শিয়ালদহ স্টেশনের উন্নত যাত্রী পরিষেবা রীতিমতো তাকে লাগায়। আধুনিকীকরণ ও উন্নত প্রযুক্তিতে দেশের একাধিক স্টেশনকে পিছনে ফেলেছে পূর্ব রেলের শিয়ালদহ স্টেশন। শহর এবং শহরতলীর মানুষের কাছে পরিবহনের একটি গুরুপত্বপূর্ণ মাধ্যম আজকের এই শিয়ালদহ স্টেশন। এরইমধ্যে শিয়ালদহ স্টেশনের ঝুলিতে অনেক সার্টিফিকেট রয়েছে। সম্প্রতি কনফাডেরেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি ইন্ডিয়ান গ্রীণ বিল্ডিং কাউন্সিলের তরফ থেকে পেয়েছে গোল্ড সার্টিফিকেট।
এক নজরে দেখা যাক কোন বিভাগে কত নম্বর পেয়ে গোল্ড সার্টিফিকেট জয় করল শিয়ালদহ স্টেশন :
১) সাস্টেনেবল স্টেশন ফেসিলিটি- ২৪/২৪
২) হেলথ হাইজিন অ্যান্ড স্যানিটেশন- ২১/২১
৩) এনার্জি এফিসিয়েন্সি ২১/২১
৪) ওয়াটার এফিসিয়েন্সি ১৬/১৬
৫) স্মার্ট অ্যান্ড গ্রীন ইনিশিয়েটিভস ১২/১২
৬) ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ৫/৬
গোল্ড রেটিং পাওয়ার পর এবার প্ল্যাটিনাম রেটিংয়ের দৌড়ে শিয়ালদহ স্টেশন। কোন কোন দিক আরও সুমসৃণ করা প্রয়োজন তা নিয়েই প্রস্তুতি চলছে রেল কর্তৃপক্ষের। তবে শিয়ালদহ স্টেশন বর্তমানে ভারতীয় রেলে শুধুমাত্র ইতিহাস সৃষ্টি করেনি, সাধারণ মানুষের কাছে এক আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।