কলকাতা কমিক্স কার্নিভ্যাল

কলকাতা শহর সংস্কৃতি

শৌভিক পাণ্ডা, কলকাতা: আমাদের এই প্রিয় শহরে শীতের হাত ধরে প্রতি বছরই হাজির হয় নানান ধরণের বিনোদনের আসর। কোথাও বসে সার্কাস, কোথাও বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। এছাড়াও ছোট থেকে বড় সকলের জন্যই রয়েছে বইমেলা থেকে শুরু করে, হস্তশিল্প সহ বিভিন্ন মেলা। এছাড়াও আমাদের চিরাচরিত চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বিড়লা তারামণ্ডল, নিক্কো পার্ক। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইকো পার্ক। কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে কলকাতায় আরেকটি নতুন বিনোদনের আসর গত কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে তা হল, কলকাতা কমিক্স কার্নিভ্যাল। কিন্তু কতজন তার খোঁজ রাখেন? তা জানতেই রবিবার শীতের দুপুরে গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছিলাম ধনধান্য স্টেডিয়ামে।
গিয়ে দেখলাম, ছোটবাক্সের দৌলতে ঘরে ঘরে ছোটদের কাছে পৌঁছে যাওয়া দেশ বিদেশের নানান সুপার হিরোদের রেপ্লিকা নিয়েই এই উৎসবের আয়োজন। আর সেখানে ভিড় জমিয়েছে বাড়ির বড়দের সঙ্গে নিয়ে সেই কচিকাঁচারাই। সুপার হিরোদের নিয়ে জমজমাট কমিক্স কার্নিভ্যালে মজেছে কলকাতার আট থেকে আশি।


গত শুক্রবার থেকে তিনদিন ধরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কলকাতার ধনধান্য স্টেডিয়ামে। যার অন্যতম মূল উদ্যোক্তা শুভময় কুণ্ডু। গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে রবিবার এই স্টেডিয়ামে দাপিয়ে বেড়াল সেই সব সুপার হিরোরা। মার্ভেল থেকে ডিসি, পুরনো ইন্দ্রজাল কমিক্স কী ছিল না সেখানে? ছিল বিভিন্ন কমিক্স বই থেকে আর্টওয়ার্ক, পোস্টার, স্টিকার। এর পাশাপাশি ছিল অসাধারণ ‘কস প্লে’ প্রতিযোগিতা। যা হল, উপযুক্ত আবহ সঙ্গীত ও ডায়লগের সঙ্গে সেই সব কমিক্সের জনপ্রিয় চরিত্র সেজে মিনিট কয়েক পারফর্ম করা। হল ঘরের মধ্যেই একপাশে আয়োজন করা হয়েছে ছোট্ট স্টেজ। সেটাই এই অভিনেতাদের রঙ্গমঞ্চ। তার সামনে ভিড় করে দর্শক। কেউ কেউ মাটিতেই বসে পড়েছেন। যার মধ্যে প্রায় অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি বললে ভুল হবে না। অভিনেতা সেজে হাজির ‘সুপার’ সব চরিত্ররা। রবিবার দুপুরে নিউজ পোলের ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে।এই কার্নিভ্যাল সম্পর্কে এর মূল উদ্যোক্তা শুভময় কুণ্ডু জানালেন, বছর পাঁচেক আগে মূলত বিদেশের একটি কার্নিভ্যালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি কলকাতায় এই কার্নিভ্যাল করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। শুধু তাই নয়। ভাবা মাত্রই তার রূপদানও করেন। কিন্তু তাঁর মনে একটা সংশয় ছিল কতটা সাড়া পাবেন? কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়েছে এই কলকাতা শহরের ‘রসিক সমাজ’। আসলে কলকাতা মানেই তো একটি সংস্কৃতি মনস্ক মানসিকতার শহর। যেখানে এই ধরনের উদ্যোগকে আপন করে নিয়েছেন কমিক্স প্রেমী মানুষ জন। এই শহরেই যে এত কমিক্স প্রেমী আছেন, তা নাকি জানাই হত না এই কার্নিভ্যালের আয়োজন না করলে! শুধু তাই নয়, আগামী দিনে তরুণ কমিক্স প্রেমীদের একজোট করে তাঁদের মধ্যে থেকেই একেক জন কমিক্স শিল্পীও তৈরি করতে চান বলে জানান তিনি।


তবে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে শুরু করে আজ প্রায় সর্বত্রই একটি কথা শোনা যায়, তা হল, আধুনিক প্রজন্ম কী বইয়ের প্রতি আগ্রহী? তাঁরা কী পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ে? তাদের কাছে সুপার হিরো মানেই তো পর্দায় নড়াচড়া করা? টেলিভিশন ও মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে চলা সেই সব চরিত্রের আবেদন সরিয়ে কতটা বইমুখী এই প্রজন্ম? প্রশ্নটি শুনে শুভময় বলেন, ‘কার্নিভ্যাল শুরুর পর দেখেছি একদম ইয়ং জেনারেশন কমিক্সের বইয়ের প্রতিও সমান আগ্রহী।’
কার্নিভ্যালের ফ্লোরে ঘুরতে ঘুরতে দেশ বিদেশের নানান সুপার হিরোদের রেপ্লিকা দেখতে দেখতে যখন অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, তাদের ফিনিশিং দেখে! ঠিক তখনই চোখে পড়লো কলকাতার বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি। জীবন্ত ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে যেন এখনই রোল কাট বলবেন। তাঁর এই মূর্তি নিয়ে এসেছেন দীপক সিং। তিনি জানান, ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যজিৎ রায়ের এই মূর্তিটি তৈরি হয়েছে রায় পরিবারের অনুমতি নিয়েই। মূল্য? প্রায় নিখুঁত মূর্তিটির দাম কার্নিভ্যালের জন্য ছিল ৩ হাজার ৭০০ টাকা। কার্নিভ্যালের পর অবশ্য তা কিনতে একটু বেশিই গাঁটের কড়ি গুনতে হবে।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, সকলের কথা মাথায় রেখেই এখানে এইসব মূর্তি, পোস্টার, স্টিকার, চাবির রিং, নিনজা শোর্ড, টি-শার্ট সহ আনা হয়েছে নানান কমিক্সের সঙ্গে যুক্ত টুকিটাকি জিনিসপত্র। আর দাম ছিল সাধ্যের মধ্যেই। দশ টাকা থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল ঘর সাজাবার নানান উপকরণ। মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিটি স্টল হোল্ডাররা একবাক্যে জানালেন, ‘সবার সামর্থের কথা মাথায় রেখেই আমরা জিনিসগুলো এনেছি। আর এই সব সুপার হিরোদের সুন্দর সুন্দর রেপ্লিকা আনা হয়েছে সুদূর জাপান থেকে।’ তাঁদের আরও দাবি, ‘আমরা চাই না, কেউ যেন এখান থেকে জিনিসের দাম বেশি বলে না কেনাকাটা করে দুঃখ মনে ফিরে যান।’


কার্নিভ্যালে যোগ দেওয়া দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীনের বাসিন্দা অনির্বাণ কর্মকার জানান, প্রথম থেকেই প্রতি বছরই তিনি এই কার্নিভ্যালে অংশ নেন। তিনি দাবি করে বলেন, ‘২০২০ সালে আমিই প্রথম এই অ্যানিমিগুলো কলকাতায় নিয়ে আসি। তারপরে অনেকেই এইগুলো নিয়ে কাজ করছেন।’
সত্যি এই কার্নিভ্যাল দেখার পরে যখন বাড়ির পথে রওনা দেওয়ার কথা ভাবছিলাম তখন আমার মতো একজন মানুষও কখন যে এই কমিক্স চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছিল তা বুঝতে পারছিলাম। মন মানছিল না। তাই আবেগ চেপে রাখতে না পেরে বলেই বসলাম, আচ্ছা এই কার্নিভ্যাল আরেকটু বেশিদিন ধরে করলে হয় না? অনেকেই তো বাদ পড়ে গেলেন? আমার কথাটা লুফে নিয়ে শুভময় বাবু বললেন, আগামী দিনে বিষয়টি নিয়ে ভাববেন তাঁরা।