নিউজ পোল ব্যুরো : বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটশিল্প, যা বহু পুরনো ও অনন্য, আজও নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। এই শিল্পটি একটি বিশেষ ধরনের পেইন্টিং যা সোনালি ঐতিহ্য এবং প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের এক মূল্যবান অংশ। তবে, বর্তমান যুগের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এই শিল্পটি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে বাঁকুড়ার ভরতপুর এই পটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। আজও এই অঞ্চলটি পটশিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
ভরতপুর, যা পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত। একসময় এই অঞ্চল বাংলার প্রাচীন শিল্পকলার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। বহু বছর আগে এখানে শুরু হওয়া পটশিল্প তা আজও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পটশিল্পের ইতিহাস বাংলার গহীন গ্রামে ঘুরে ফিরে দেখা যায়, যেখানে এটি একসময় গ্রামের লোকজীবনের অংশ ছিল। পটশিল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য, ধর্মীয় কাহিনী, পৌরাণিক চরিত্র, রামায়ণ মহাভারতের ঘটনাবলী চিত্রিত করতেন।
ভরতপুরে পটশিল্পের প্রতিরোধের মূল কারণ হচ্ছে এখানকার শিল্পীরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে আসছেন। একদিকে, আধুনিকতার ছোঁয়া, ডিজিটাল মিডিয়া ও মুদ্রণ শিল্পের ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে পটশিল্পের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষ এবং সরকারী সাহায্য ও উদ্যোগ পটশিল্পের বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
ভরতপুরের পটশিল্পীরা এখনও হাতে আঁকা, খাঁটি সোনালী কাগজে আঁকা ছবির মধ্যে তাদের শিল্প প্রদর্শন করেন। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে রং ব্যবহার, ছবি আঁকার শৈলী, এবং মাটির তৈরী পটের উপর চিত্রিত দৃশ্যগুলি এখনও সেই পুরনো সোনালী সময়ে ফিরে যেতে সাহায্য করে। তাঁরা আজ পর্যন্ত কোন কেনা রং বা কেমিক্যাল রঙের ব্যবহার করেননি। ছবি আঁকার জন্য শুধুমাত্র কাগজটাই তাঁরা বাইরে থেকে কেনেন। প্রকৃতি থেকে তাঁরা জোগাড় করে নেন নিজেদের রং,তুলি, আঠা সহ আঁকার সামগ্রিক জিনিস। শুশুনিয়া পাহাড়ের কোল থেকে তাঁরা বিভিন্ন রঙের পাথর ও পাতা সংগ্রহ করে আনেন। সেই রঙিন পাথরগুলো গুঁড়ো করে আর পাতাগুলো বেটে তাঁরা আঁকার রং প্রস্তুত করেন। এই শিল্পীরা শুধুমাত্র প্রাচীন ছবি আঁকেন না, তারা আধুনিক সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ও তাদের পটের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
ভরতপুরের পটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই শিল্পের সমর্থনে বিভিন্ন প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। এছাড়া, স্থানীয় এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও পটশিল্পীদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের কাজের প্রসার করার জন্য নানা কর্মসূচি চালাচ্ছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে পটশিল্পীরা তাদের কর্মজীবন আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি পটশিল্পের প্রাচীন কৌশলও নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছেন।
ভরতপুরের পটশিল্পীরা এখন শুধু স্থানীয় বাজারে তাঁদের কাজ বিক্রি করেন না, তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের শিল্প প্রদর্শন করছেন। তাঁদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বিদেশেও, এবং অনেক বিদেশি ক্রেতা তাদের পটশিল্প সংগ্রহ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। এভাবে, বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ভরতপুরের শিল্পীরা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে পুরো রাজ্য এবং দেশের কাছে একটি আলাদা স্থান অর্জন করেছেন। এই শিল্পের মাধ্যমেই তাঁরা প্রমাণ করেছেন, প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, শুধু তার জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের নিষ্ঠা এবং ভালোবাসা।
ভরতপরের পটচিত্র শিল্পীরা আঁকার জন্য যে তুলিটি ব্যবহার করেন সেগুলো ছাগলের লোম দিয়ে তৈরী হয়। এই গ্রামে মূলত দুই ধরণের পটচিত্র তৈরী হয় – একটি জড়ানো পট, আরেকটি চৌকো পট। আগে হয় গান পরে হয় পট। যেখানে শিল্পীরা নিজেরাই নিজেদের সুর দিয়ে গান তৈরী করেন। কিন্তু বর্তমানে সেইসব পটগান বিলুপ্তপ্রায়। আজকাল খুব কম মানুষ পটগান শুনতে ভিড় করেন বা মূল্য বোঝেন। কিন্তু তবুও বাংলার এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে পটগান গাওয়া থামাতে পারেনি এই দিন দরিদ্র মানুষেরা। তাই কখনও বাঁকুড়া গেলে অবশ্যই ভরতপুর গ্রাম ঘুরে আসবেন। এই গ্রামের পটশিল্পীদের আঁকা পটচিত্র কিনে দেখবেন আর তাতেই এই মানুষগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্ব বাংলার এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা।