দেবপম সরকার: আজ এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন। আজ শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব পূণ্য স্নানযাত্রা। এই পূণ্য তিথিতেই শ্রীক্ষেত্রে প্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র , দেবী সুভদ্রা ও সুদর্শনকে স্নানবেদীতে এনে ১০৮ কলস পূণ্য বারিধারায় পাবমানী মন্ত্রে স্নান করানো হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় জগন্নাথ মহাপ্রভুর দীর্ঘ একপক্ষকাল প্রবল জ্বর আর তারপর আষাঢ়ের শুল্কা দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রথযাত্রা। শ্রী শ্রী মহাপ্রভুর স্নান যাত্রার সাথে সাথে আজ আরও একটি বিশেষ দিন। আজ বেলুড় মঠের (Belur Math) গর্ভগৃহে শ্রীশ্রী ঠাকুরের পবিত্র অস্হিভস্ম যা স্বামিজীর শ্রীমুখের দেওয়া নাম “আত্মারামের কৌটো” বা “শ্রীজী” তাঁকেও আজ পুণ্যস্নান করানো হয়। আজই কালীক্ষেত্র কলকাতার (Kolkata) মূলপীঠ তথা সতীপীঠ কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহে রুদ্ধ কপাট গৃহে শিলাবস্তু,সতীঅঙ্গ বা ব্রহ্মবস্তুর স্নানাভিষেক হয়। তাই আজ ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ (Ramakrishna Paramhans) ভাবমন্ডলীরও একটি বিশেষ দিন।
আরও পড়ুন: PhD In Belur: পিএইচডি-র সুযোগ মিলবে এবার বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে! কিন্তু কোন কোন বিষয়ে?
শ্রী শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভুর স্নান যাত্রার দিনে অর্থাৎ আজকের দিনেই জানবাজারের পুণ্যবতী লোকমাতা রানী রাসমণি (Rani Rasmoni) কাশীধাম যাওয়ার পূর্বে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দির ও মা ভবতারিণীর প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের তথা ভারতবর্ষের যুগধর্মের সূচনা করে| দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ভাবে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে তিনি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (Ramakrishna Paramhans)। ১৮৫৫ সালে দাদা রামকুমারের সহযোগীরূপে এখানে আসেন। পরে রামকুমারের মৃত্যুর সময় তিনি দাদার স্থলাভিষিক্ত হন। এবং তারপর ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছিলেন দক্ষিনেশ্বরের এই মন্দিরেই। দেশে বিদেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম। বহু দূর দূর থেকে মানুষ ছুটে আসতে থাকেন মন্দিরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের (Ramakrishna Paramhans) সন্নিকটে।আজও বিপুল সংখ্যক মানুষ এই মন্দিরে আসেন মায়ের দর্শন করতে।

শতাব্দীপ্রাচীন এই নবরত্ন মন্দিরের আকর্ষণ আজও একই রকম রয়ে গিয়েছে। এবং কিংবদন্তি মতানুসারে, ঠিক দিনের আগের দিনই জানবাজারের লোকমাতা রানী রাসমণির স্বপ্নে আসেন মা কালী স্বয়ং। তিনি তাঁকে জানান, কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই রাসমণির। তিনি যেন একটি মন্দির স্থাপন করে গঙ্গাতীরেই নিত্য আরাধনা শুরু করেন মা কালীর। এই স্বপ্নই রাসমণিকে প্রেরণা জোগায়। তিনি গঙ্গাতীরে জমি কেনেন। শুরু হয় মন্দির নির্মাণের কাজ। একসময় তা শেষ হয়। মাঝে কেটে গেছে আট বছর। শেষপর্যন্ত স্বপ্নের আদেশ পালন করে সত্যি সত্যিই গড়ে ওঠে দক্ষিনেশ্বরের সুউচ্চ মন্দির।
দক্ষিনেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠার গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। এবার আসা যাক এই মন্দির তৈরির পিছনের স্বপ্নকে। ১৮৪৭ সালে রানি রাসমণি ঠিক করেন, তিনি কাশীতে (Kashi) তীর্থযাত্রায় যাবেন। সেইমতো ২৪টি নৌকায় আত্মীয় পরিজন, দাসদাসী নিয়ে যাত্রা করতে মনস্থ করেন তিনি। ১৮৫৫ সালের আজকের দিনে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা রানি রাসমণি। একটা স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নকে সত্যি করার ইচ্ছে। এবং অবশেষে তার সফল বাস্তবায়ন। সহজে বললে এভাবেই গড়ে উঠেছিল দক্ষিণেশ্বর (Dakshineswar) কালীবাড়ি। ১৮৪৭-তে শুরু হয় মন্দির নির্মাণ। এবং তা শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের স্থাপত্য সত্যিই নয়নাভিরাম। সেই সময়ে এই মন্দির তৈরি করতে লেগেছিল প্রায় ৯ লক্ষ টাকা! যা সেই সময়ের নিরিখে বিরাট অর্থ।
জমিদার বাড়ির বিধবা পত্নী রাসমণি, যাঁর উপরেই সেই সময়ে ছিল জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব, তিনি সেই বিপুল অর্থ খরচ করে গড়ে তুলেছিলেন সনামধন্য দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরটি। পাথর কুঁদে তৈরি করা হয়েছিল মূর্তিটি। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে সহস্র পাপড়ির রৌপ্য-পদ্মের উপরে শুয়ে থাকা শিবের বুকে দেখা যায় মা ভবতারিণী কালীকে।এই দিনেই সতী অঙ্গে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাই স্নানযাত্রাকে কালীঘাটের মায়েরও আবির্ভাব তিথি হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। কালীঘাট (Kalighat) মন্দিরে এদিন সতী অঙ্গের প্রস্তরীভূত শিলাটিকে স্নান করানো হয়। স্নানযাত্রার দিন ভোরে নিয়ম মেনে স্নান উৎসবের সূচনা হয়। পূজারীরা স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরে চোখে কাপড় বেঁধে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন। শিলাকে গঙ্গাজল, অগুরু,জবাকুসুম তেল, আতরের মিশ্রণ দিয়ে স্নান করানো হয়। স্নানের পর সতী অঙ্গ মুছে তাঁকে বেনারসি বস্ত্র দিয়ে ঢেকে আবার রুপোর সিন্দুকে ভরে রাখা হয়। বেলুড় মঠে (Belur Math) স্নান করানো হয় আত্মারামের কৌটোকে। এদিন বাইরে বের করে আনা হয় সেটি। তারপর স্নান করিয়ে বিশেষ পুজো করা হয়। প্রসঙ্গত, আত্মারামের কৌটে শ্রীরামকৃষ্ণের অস্থি-চিতাভস্ম থাকে।
নিউজ পোল বাংলা ইউটিউব লিঙ্ক:- https://youtube.com/@newspolebangla?si=mYrQvXTBQ1lG3NFT