রাম সেতুই কি আদম সেতু? ঐতিহাসিক বিতর্ক আজও জারি

breakingnews ইতিহাস

নিউজপোল ব্যুরো: রাম সেতুই নাকি আদম সেতু ! তবে জানেন কি দুই ধর্মের ভিন্ন নামে পরিচিত এই সেতুর সঠিক নাম আসলে কোনটি? কেন এই সেতু তৈরীর ইতিহাস ঘিরে এখনও রয়েছে বহু বিতর্ক।

হিন্দুদের মতে যা রাম সেতু, সেটাই আবার মুসলমানদের মতে আদম সেতু। ভারত ও শ্রীলংকাকে সংযোগকারী বিশেষ এই সেতুর ইতিহাস ঘিরে আদি যুগ থেকেই রয়েছে নানান বিতর্ক। হিন্দু-মুসলিমের ঐতিহাসিক কাহিনীর ভিত্তিতে রয়েছে যুক্তির উপর পাল্টা যুক্তি। অবশ্য দুই ধর্মেরই কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী ঘাটলেই বোঝা যাবে এই সেতুর পিছনের ইতিহাস নিয়ে জল্পনা থাকাটাই স্বাভাবিক। মজার বিষয় হল দুই ধর্মের বিতর্কের মাঝে মিলে যায় অনেক কিছুই। হিন্দুধর্মের পৌরাণিক নানা কাহিনী সময় অনুযায়ী মিলে যায় সেতুর প্রতিটি উপাদানের বয়স। আবার অপরদিকে খুব অদ্ভুত ভাবে মিলে যায় এই সেতুর ইতিহাস ঘিরে মুসলিম ধর্মের বেশীরভাগ যুক্তিও। তাইতো আজও পর্যন্ত এই সেতুকে ঘিরে রয়েছে বহু বিতর্ক।

এই সেতুর ইতিহাসটা ঠিক কেমন? কি রয়েছে এই সেতু তৈরীর রহস্যাবৃত গল্পে ? নবী কাহিনী নাকি রাম কাহিনী ! নাকি তেমন কিছুই না, আদতে এসবের আড়ালে রয়েছে ভৌগোলিক কারণ ? প্রশ্ন রয়েছে অনেকেরই।

৪৮ কিলোমিটার তথা 30 মাইল দীর্ঘ এই সেতু।মুসলমানদের দাবি প্রথম মানব তথা নবী হজরত আদম সর্বপ্রথম এই সেতুর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে আসেন। অপরদিকে হিন্দুদের দাবি এই সেতু বানর সেনা দ্বারা নির্মিত হয়, যাতে রাম দেবতা শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে সীতাকে উদ্ধার করতে পারেন। হিন্দুত্বের পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত আছে এই সেতুর উপর দিয়েই সীতাকে বাঁচাতে শ্রীলঙ্কায় রাবণের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় রাম ও তার বানরসেনা। এমনকি এটাও বলা হয়েছে যে রামের বানর সেনারাই নাকি টুকরো টুকরো পাথর দিয়ে নির্মাণ করে এই সেতু। সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী ওই সেতু তৈরির পূর্বে প্রতিটি পাথরের উপর হয়েছিল ‘শ্রী রাম’ আর তার জন্যই নাকি পাথরগুলো না ডুবে তৈরি হয় এমন মস্ত সেতু। তাই হিন্দুদের দাবি এই ভাসমান পাথর দিয়ে তৈরি সেতুই হলো ভারত-শ্রীলংকা সংযোগকারী রাম সেতু।

এই সেতুর পাথর ও বালির পরীক্ষা করে জানা যায় বয়স প্রায় ৭০০০ থেকে ১৮ হাজার বছর পুরনো। কিন্তু শ্রীলংকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে এই সেতুর বয়স আনুমানিক ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ বছর। যদিও এই সেতুটি মানবসৃষ্ট নাকি ভৌগোলিক কারণে সৃষ্ট তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কেউই। কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই কাজে লাগেনি এই সেতু তৈরীর রহস্যাবৃত ইতিহাস উদঘাটনে। সমুদ্রের কিছু কিছু জায়গা খুব অগভীর। কোন কোন জায়গায় সমুদ্র মাত্র তিন ফুট থেকে ত্রিশ ফুট গভীর। এই কারণে স্যাটেলাইট ইমেজ বা প্লেনে করে যাতায়াতের সময় এই সেতুকে অনেক টাই স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়।

ভৌগলিক সৌন্দর্যের সাথে ধর্মীয় কাহিনী মিলে যেন আরও বেশি করে এই সেতুকে আকর্ষণীয় করে তোলে পর্যটকদের কাছে। কেউ আসেন সেতুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে, তো আবার কেউ কেউ আসেন ধর্মীয় কাহিনীর টানে। হাজার হাজার পর্যটকদের আকর্ষণ হয়ে উঠছে এই সেতু। নানান তর্ক বিতর্কের মাঝেই এই সেতু বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এমনকী এখানে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াবার জন্য দূরবীন দিয়ে সমুদ্রের ওপারে থাকা শ্রীলংকার মান্নার উপকূল দেখার ব্যবস্থাও। শোনা যায় ১৪৮০ সালে একটি ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়ার আগে পর্যন্ত এই সেতুর সবটাই জলতল থেকে ছিল উপরে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পর সেতুর কিছু কিছু অংশ ডুবে গিয়েছে জলের নিচে। দূরবীন দিয়ে সেতুর সেই সমস্ত জেগে থাকা অংশ দেখা গেলেও খালি চোখে তা দেখা একেবারেই সম্ভব নয়। কখনো ভারত মহাসাগর আবার কখনো বঙ্গোপসাগরে জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে জেগে ওঠা অংশে।

তবে গবেষকদের ধারণা ভৌগলিক কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে অবস্থিত অন্যান্য সমস্ত কিছুর মতোই সৃষ্টি হয়েছে এই সেতুরও। কিন্তু বৈজ্ঞানিক এই ধারণাকে একেবারে মানতেন নারাজ হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা। নিজ ধর্মের কাহিনী মেনে বর্তমান যুগেও বহু মুসলমানদের দাবি প্রাকৃতিকভাবে নয় বরং তাদের ধর্মে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ীই নির্মিত হয়েছিল এই সেতু। অপরপক্ষে রামায়ণ কথায় বর্ণিত সেতুর নির্মাণের সময় অনুযায়ী অনেক টাই মিলে যায় ভূতাত্ত্বিকদের আনুমানের ভিত্তিতে সেতুর বয়স, তাই কিছু হিন্দুদেরও দৃঢ় বিশ্বাস প্রভু রামের জন্যই নির্মিত হয়েছিল এই সেতু। অতএব এই সেতুকে আদম সেতু বলা যাবে নাকি রাম সেতু তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেবলমাত্র যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন এলে তবেই ভারত-শ্রীলংকার সংযোগকারী এই সেতু সৃষ্টির আসল সত্যতা যাচাই করা সম্ভব।