নিউজ পোল ব্যুরো: কোন ব্যক্তি দেহত্যাগ করলে , শোকে নয় সেটা উৎসবে পরিণত হয় । কী শুনেই কেমন অদ্ভুত লাগছে তাই না ? হ্যাঁ এটাই সত্যি। ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে এমনই এক হোটেল আছে যেখানে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে উৎসব পালিত হয়। কিন্তু এর পিছনে কি কারণ আছে যেখানে কাছের মানুষের মৃত্যুতে শোক নয় উৎসব পালন করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই বিষয়ে —-
উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে কাশী লাভ মুক্তি ভবন নামক হোটেলে মানুষ ঘুরতে নয়, দেহত্যাগ করতে আসেন। কিন্তু কেন? প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই হোটেলে নাকি মানুষ দেহত্যাগ করলে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না। তাই ভারতবর্ষের এই হোটেলে মানুষ মূলত মোক্ষলাভ করতে আসেন। যখন কোন মানুষ অনুভব করেন তিনি অন্তিম পর্যায়ে চলে এসেছেন তখনই সেই ব্যক্তির পরিবার এই হোটেলে নিয়ে আসেন। যদিও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের জন্য এই হোটেলের থাকার মূল্য খুবই সামান্য, মাত্র ১৫ দিন। কিন্তু এটি ধার্য শুধুমাত্র ১৫ দিনের জন্য। এই ১৫ দিনের মধ্যে ব্যক্তির মৃত্যু না হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ ওই মৃত্যুপথাত্রীকে আবারও বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
এই মুক্তিভবনে এখনও পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মানুষের মোক্ষ লাভ হয়েছে অর্থাৎ এখানে এসে দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু কেন এই মুক্তিভবনকে এত পবিত্র মনে করে মানুষ? এই মুক্তিভবন থেকে কি সত্যি মানুষের মোক্ষ লাভ হয় ?
বেনারস মানেই হর হর মহাদেবের স্থান। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেনারস অত্যন্ত একটি পবিত্র স্থান। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই বেনারসের স্থান স্বয়ং মহাদেবের ত্রিশূলের ডগায় । তাই বেনারসকে ‘মহাদেবের শহর’ বলা হয়। অনেকের বিশ্বাস স্বয়ং মহাদেব না চাইলে এই বেনারসে না কি কেউ আসতে পারেন না। এই বেনারসে রয়েছে মহাদেবের দ্বাদশ জ্যোতির লিঙ্গ, যা ‘বাবা বিশ্বনাথ’ নামে খ্যাত। তাই কথিত আছে, এই পূণ্য শহরে কেউ যদি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাহলে জন্ম মৃত্যুর যাঁতাকল থেকে সে চিরজীবনের জন্য মুক্তি পায়। বিশ্বের এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমোতে নয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে আসেন। অনেক মানুষকেই বলতে শোনা যায় তাঁরা শেষ বয়সে কাশী-বিশ্বনাথের চরণে ঠাঁই পেতে চান। আসলে বারাণসীকে পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র শহর বলে মনে করা হয়। এই বারাণসীর প্রতিটা ঘাটে আজও প্রাচীন ভারতের একটুকরো ছবি বর্তমান।
এই মুক্তিভবনকে বাইরে থেকে দেখলে যদিও হোটেল বলে মনে হবে না, মনে হবে একটা দোতলা বাড়ি। কিন্তু মুক্তিভবনের ভেতরে ঢুকলেই আপনি দেখতে পাবেন সাদা এবং সবুজ রঙের সারি সারি ঘর আর প্রতিটা ঘরে দুটো করে চৌকি পাতা। ১৯৫৮ সালে এই মুক্তিভবন তৈরি করেছিলেন শিল্পপতি জইদ দয়াল ডালমিয়া । জইদ দয়াল ডালমিয়ার মা কাশী নিবাসী ছিলেন। তাঁরই ভাবনাতে তৈরি হয়েছিল এই মুক্তি ভবন । তিনি দেখেছিলেন প্রচুর মানুষ আসেন কাশীতে আসেন মোক্ষলাভ এর জন্য কিন্তু তাঁদের কোন থাকার জায়গা নেই আর কোন হোটেল এই মোক্ষলাভ এর জন্য আলাদা করে জন্য ঘর ছেড়ে দেবে না। তাই সেই মানুষগুলোর কথা ভেবেই তৈরি হয়েছিল এই মুক্তিভবন । এই মুক্তি ভবনে রয়েছে ১০ টা ঘর যেখানে প্রতিটা ঘিরে একজন করে মৃত্যুপথাত্রী তার পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে শোয়ার জায়গা এই সবকিছুরই ব্যবস্থা করে দেন এই মুক্তি ভবন কর্তৃপক্ষ ।
যদিও মানুষ এই মুক্তি ভবনে সেই সময়েই আসেন যখন তাকে চিকিৎসকেরাও জবাব দিয়ে দেন বা যখন কোনো ব্যক্তির নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ হয়ে যায় সেই সময়ে তাঁরা এই মুক্তি ভবনে এসে থাকেন । ডালমিয়া ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এই মুক্তি ভবনের অতিথিদের থেকে কোন টাকা পয়সা নেওয়া হয় না শুধুমাত্র ইলেকট্রিকের বিল বাবদ প্রতিদিন ২০ টাকা করে নেওয়া হয়। তাও যদি কোন ব্যক্তি দিতে না পারেন তাঁকে কোন জোর করা হয় না। এই মুক্তি ভবনে যে কোন ধর্মের মানুষ আসতে পারে। তবে এই মুক্তি ভবনে কোন অনলাইনে বুকিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
এখানে আসার পর কোন ব্যক্তির মৃত্যু শ্বাস উঠলে সকলে প্রার্থনা করেন তাঁর মোক্ষলাভের জন্য। মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে দেন এই ভবন কর্তৃপক্ষ। এই মুক্তি ভবনের ভেতরেই রয়েছে মন্দির যেখানে তিন বেলা নিয়ম করে আরতি হয়। এখানে চার কর্মী এবং একজন পুরোহিত রয়েছেন। এই ভবনের পুরোহিত প্রতিটা ঘরে যান এবং ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে শোনান। তবে ১৫ দিনের মধ্যে কারও মোক্ষলাভ না হলে সেই ব্যক্তিকে আবারও বাড়ি পাঠিয়ে দেন ভবন কর্তৃপক্ষ।
আসলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আর ভোলনাথের ওপর সেই বিশ্বাসকে সঙ্গী করে দেশ বিদেশ থেকে বহু মানুষ এসে এই মুক্তি ভবনে ওঠেন । আপনারা কোনোদিন বেনারস ঘুরতে গেলে এই মুক্তি ভবন চাক্ষুষ দেখে আসতে পারেন। পৃথিবীর এই একটি মাত্র ভবন যেখানে মানুষের চলে যাওয়াটা আনন্দের ।