নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: দক্ষিণ শহরতলি থেকে ট্রেন ঢুকল নিউ গড়িয়া স্টেশনে। রিমি আজ প্রথম মেট্রোয় চড়বে। তারপর ঠাকুর দেখবে বাবা-মায়ের হাত ধরে। কিন্তু প্রথম দিন মেট্রো চড়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হল না। ট্রেনে উঠেই ক্লাস ফোরের রিমি বলল, ‘ও বাবা! এ তো আমাদের লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালের মতোই ভিড়।’ বাবা বোঝালেন, ‘ঠান্ডা হাওয়া পাচ্ছ না?’ ‘সে আসছে। কিন্তু নামব কখন?’ প্রশ্ন জুড়ল রিমি। কালীঘাটে নেমে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে গড়িয়াহাট দেখার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। দেশপ্রিয় পার্কের ফুটপাত ধরতেই জনসমুদ্র। ক’টা বাজে তখন? সবে দেড়টা। ওই দুপুর থেকেই দক্ষিণ থেকে উত্তরে জনজোয়ারে ভাসল শহর। হাঁটতে হাঁটতে কেউ বিভ্রান্তি মিটিয়ে নিলেন বন্ধুদের সঙ্গে, ‘আজ চতুর্থী না পঞ্চমী?’ উত্তর আসতেই চেনা মন্তব্য, ‘চতুর্থীতেই এত ভিড়!’
বাসে বসে মা ছেলেকে একটু রাগী গলাতেই ফোনে বললেন, ‘কোথায় আছিস? আর কতক্ষণ লাগবে ফিরতে?’ ফোন রাখতেই রাগটুকু ঝেড়েপুঁছে সাফ। একগাল হেসেই বাবাকে বললেন, ‘এখন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে আছে। সেই সকাল ন’টায় বেরিয়েছে। বলছে, আরও দেরি হবে। ফোন কোরো না এখন।’ পুজো মানেই বাবা-মায়ের একটু ছাড়। পুজো মানেই সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি। আর সেই ‘ছাড়পত্র’ হাতে নিয়ে ভিড়ের মাত্রা লাফিয়ে বেড়েছে তৃতীয়ার রাত থেকেই। টালা থেকে একডালিয়া—গভীর রাতেই উপচে পড়েছিল ভিড়। সবচেয়ে বড় কথা, রাতের রেশ ধরে থাকল শারদীয়ার সকালও। কার্যত ভোর থেকেই আম জনতার ঠাকুর দেখা শুরু। ভোরবেলার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে সেই চিত্র। আলো ফুটতেই টালা প্রত্যয়, টালা বারোয়ারি, কাশী বোস লেন, হাতিবাগান সর্বজনীন, কুমোরটুলি পার্ক, জগত্ মুখার্জি পার্কের পথে শুধুই মানুষের মাথা। শুধু বারোয়ারি পুজো নয়, শোভাবাজার রাজবাড়িতেও চোখে পড়ল তরুণ-তরুণীদের ভিড়। ইউটিউবাররা বনেদি বাড়ির নকশাকে ব্যাকড্রপে রেখে দেদার ফোটোসেশন চালিয়ে গেলেন। উত্তর থেকে দক্ষিণের এই সামগ্রিক জনজোয়ারের ফাঁসে বেশকিছু জায়গায় থমকে গেল ট্রাফিক। দাঁড়িয়ে থাকা বাস থেকেই দেখা গেল, যাত্রীরা নেমে মণ্ডপের পথে হাঁটা শুরু করেছেন। ক্লান্তি কোনওভাবেই গ্রাস করতে পারেনি বাঙালিকে। একডালিয়া থেকে সিংহী পার্ক, সেখান থেকে বালিগঞ্জ কালচারাল বা সমাজসেবী—গোটা পথ সেজেছে ঝলমলে রঙিন আলোয়। চারদিক থেকে আইসক্রিম, খাবারদাবারের দোকান থেকে উড়ে আসছে হাঁকডাক। এদিনই পথে কলকাতা পুলিসের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের দেখা গেল। তার সঙ্গে নীল পোশাকের ভলান্টিয়াররাও ট্রাফিক সামলাতে নেমে পড়েছেন।
হাঁটতে হাঁটতে পেটে টান। রেস্তরাঁ দূরেই থাক। সেখানে লম্বা লাইন। এই ক’দিন ফুটপাতের জাঙ্কফুডেই ভরসা। রাস্তার ধারের ‘বাঙালি চাইনিজ’ এবং স্ন্যাক্সের স্টলের সামনে বেঞ্চ পেতে বসেই চলল পেটপুজো। সব মিলিয়ে পুজো আসতে যতটুকু যা বাকি ছিল, সব আক্ষেপ মিটল চতুর্থীর সকালেই। চেনা ভিড়, আর মানুষের উৎসব-মেজাজ জানান দিল, পুজো পরিপূর্ণ রূপে চলে এসেছে এই বঙ্গে।