নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: আজ বৃহস্পতিবার, ডায়মন্ড হারবারে নিজের সংসদীয় কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মসূচি ‘সেবাশ্রয়’-এর উদ্বোধন করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি ফের দলের সাংগঠনিক রদবদল নিয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করেন। অভিষেক জানালেন, “দলের মধ্যে সাংগঠনিক রদবদল হবে এবং সঠিক সময়ে হবে। তিনি বলেন, “যাঁরা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাঁদের চিন্তার কিছু নেই। গাছের পরিচয় তার ফলে। কতটা দক্ষ, কতটা অভিজ্ঞ, তা ফলাফলের মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে।”
ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ জানান, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এরইমধ্যে তিনি সাংগঠনিক রদবদলের একটি প্রস্তাব দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়েছেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলনেত্রীই। অভিষেক বলেন, “পর পর ভোট এবং উৎসব ছিল। তবে ঠিক সময়েই রদবদল হবে।”
উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকেই সাংগঠনিক রদবদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অভিষেক। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনে যেখানে দলের ফলাফল খারাপ হয়েছে, সেসব এলাকায় প্রশাসনিক স্তরে রদবদল হবে। এই প্রসঙ্গে প্রায় ৭০টি পুরসভা ও পুরনিগমে চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে রদবদলের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তিনি। তবে নিজের জন্মদিনে, ৭ নভেম্বর, একান্ত আলোচনায় অভিষেক জানান, আপাতত এই রদবদলের আওতার বাইরে থাকবে কলকাতা। তিনি আরও স্পষ্ট করেন যে, এই রদবদলের ভিত্তি হবে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। সাংগঠনিক রদবদলের বিষয়টি ফের উল্লেখ করে অভিষেক বলেন, “যাঁরা দলের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কাজ করছেন, তাঁদের উদ্বেগের কিছু নেই। ফলাফলই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবে।”
২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তিন মাসের মধ্যে দলের মধ্যে রদবদল হবে। কিন্তু সেই নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনও সেই রদবদল কার্যকর হয়নি। নভেম্বর মাসে অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের তরফে জানানো হয়েছিল যে, ছ’টি উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমীকরণ নিয়ে দলে নানা আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে অভিষেক পুনরায় জানিয়েছেন, রদবদল হবেই। তবে কবে এই রদবদলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তৃণমূলের এক শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, রদবদল নিয়ে কাজ চলছে এবং দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গেও তিনি কিছু ক্ষেত্রে আলোচনা করছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
লোকসভা ভোট-পরবর্তী পর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে নেতৃত্বের সমীকরণ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠে আসছে। সম্প্রতি দলের মুখপাত্রদের তালিকা প্রকাশের পর থেকে এই আলোচনা আরও জোরাল হয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা দলের মধ্যে ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের বাদ পড়া নিয়ে শাসকদলের অন্দরে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
তবে বৃহস্পতিবার এই জল্পনা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, “আমার কাজ দলে দলে ঢুকে জোড়াফুল ফোটানো। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী আমার সঙ্গে দেখা করলে সেটি খবর হওয়ার কোনও কারণ নেই!ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ আরও বলেন, “আমি পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী আমার সঙ্গে বৈঠক করতেই পারেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা সহকর্মী, সহযোদ্ধা। একসঙ্গে কাজ করাটাই আমাদের উদ্দেশ্য।”
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের এক সভায় দীর্ঘ প্রায় সওয়া এক ঘণ্টার বক্তব্যে আরজি কর হাসপাতালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘বিরোধীরা বলেছিলেন আরজি কর হাসপাতালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চক্রান্ত করেছেন। অথচ আজ দেখুন, সেই প্রসঙ্গ তারা তুলছেন না।’’আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রসঙ্গও উঠে আসে অভিষেকের বক্তব্যে। সিবিআই-এর ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘অভিযুক্তকে প্রথমে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশই।’’এছাড়া, ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ৩০০টি স্বাস্থ্যশিবিরে যাওয়া রোগীদের উন্নত চিকিৎসার প্রসঙ্গেও কথা বলেন অভিষেক। তিনি জানান, এই শিবিরগুলিতে রোগীদের ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে রাজ্যের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে পাঠানো হবে উন্নত চিকিৎসার জন্য। এই তালিকায় রয়েছে এসএসকেএম হাসপাতাল, ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশাপাশি আরজি কর হাসপাতালও।
মণিপুরের অশান্তি, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং আবাস যোজনাসহ একাধিক ইস্যুতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিষেক বলেন, “বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি ঢুকিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করার চেষ্টা চলছে। এই জঙ্গিদের গ্রেফতার করছে রাজ্যের পুলিশ। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব কোথায়?” আবাস যোজনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়েও সরব হন অভিষেক। তিনি দাবি করেন, “মোদী সরকার এখনো আবাস যোজনায় বরাদ্দ অর্থ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারেনি। প্রকল্পের টাকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেওয়া হয়নি। বরং কেন্দ্রের রাজনৈতিক স্বার্থে রাজ্যের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমি চ্যালেঞ্জ করছি, যদি কেন্দ্র প্রমাণ করতে পারে যে প্রকল্পের টাকা আমরা পাইনি, তাহলে আমি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইব।”
ডায়মন্ড হারবার লোকসভার অন্তর্গত প্রতিটি বিধানসভা এলাকায় আগামী ৭৫ দিন ধরে চলবে সেবাশ্রয় কর্মসূচি। তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রতিটি ৬-৭টি বুথপিছু থাকবে একটি করে স্বাস্থ্যশিবির। এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, “ভারতে এর আগে কেউ এই কাজ করার সাহস দেখায়নি।” তিনি অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদেরও এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন যে, প্রয়োজন হলে তিনি তাঁদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ নভেম্বর আমতলায় আয়োজিত একটি চিকিৎসক সম্মেলনে (ডক্টরস সামিট) অংশগ্রহণ করেছিলেন অভিষেক। সেই সময়েই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ডায়মন্ড হারবারের সাতটি বিধানসভা এলাকায় জানুয়ারি মাস জুড়ে স্বাস্থ্যশিবির হবে। প্রতিটি বিধানসভায় ১০ দিন ধরে এই শিবির পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কর্মসূচি উপলক্ষে আয়োজিত ওই সম্মেলনকে কেউ কেউ অভিষেকের চিকিৎসকদের সঙ্গে তৃণমূলের সেতুবন্ধনের প্রয়াস বলে চিহ্নিত করেছেন। এর পটভূমিতে রয়েছে রাজ্যের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উল্লেখ্য, আগের দু’মাসে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি এবং জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে সরগরম ছিল রাজ্য রাজনীতি।