মানকুণ্ডু স্টেশন তো চেনেন, কিন্তু জানেন কী এর কাহিনী?

জেলা রাজ্য

নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি: কলকাতা ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বহু জমিদার ও ব্যবসায়ীর কিংবদন্তি গল্প প্রচলিত আছে, যাঁরা তাঁদের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও বৈভবের জন্য পরিচিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেরই জীবন ছিল বিলাসিতার এক অনন্য উদাহরণ। তবে এমন কয়েকজন ছিলেন, যাঁদের কারণে কোন বিশেষ স্থানের সৃষ্টি হয়েছে বা ইতিহাস গড়ে উঠেছে। তেমনই একজন ছিলেন গৌর খাঁ। আজও তাঁর নাম উচ্চারিত হয় এক প্রবাদ বাক্যে – ‘সাবধানে খরচ করিস, না হলে গৌর খাঁ হয়ে যাবি।’ এই প্রবচনের পিছনে লুকিয়ে আছে এক শৌখিন ধনবান ব্যবসায়ীর অবিশ্বাস্য ব্যয়ের কাহিনী, যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিঃস্ব করে দেয়। তবে তাঁর অতিরিক্ত খরচ ও বিলাসিতারই ফলস্বরূপ জন্ম নিয়েছিল মানকুণ্ডু স্টেশন।

গৌর খাঁ ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী, যাঁর বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল মানকুণ্ডুতে। তাঁর বাড়ির চারপাশে ছিল বিস্তীর্ণ বাগান, জলাশয় ও প্রচুর চাকর – বাকর। কলকাতায় ব্যবসার কাজে যাতায়াত করার জন্য তিনি শুরুতে জুড়ি গাড়ি ব্যবহার করতেন। কিন্তু ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট যখন হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়, তখন তিনি ট্রেনে যাতায়াত শুরু করেন। তখনও মানকুণ্ডুতে কোনো স্টেশন ছিল না। চন্দননগর ও ভদ্রেশ্বরের মাঝখানে এই অঞ্চল পড়লেও ট্রেন থামানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু গৌর খাঁ’র ইচ্ছা ছিল তিনি মানকুণ্ডু থেকেই ট্রেনে উঠবেন। তাই তিনি তাঁর এক কর্মচারীকে চন্দননগরে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট স্থানে এসে চেন টেনে ট্রেন থামাতেন। এরপর গৌর খাঁ ট্রেনে ওঠার পরেই ট্রেন পুনরায় যাত্রা শুরু করত। এই কারণে প্রতিদিন বিরাট অঙ্কের জরিমানা দিতে হাত গৌর খাঁকে। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি নজরে আসে অডিটের সময়। সরেজমিনে তদন্ত করতে এসে তাঁরা দেখেন এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর চাপে প্রতিদিন ট্রেন থামাতে হচ্ছে। এরপর রেল কর্তৃপক্ষ স্থায়ীভাবে এখানে একটি স্টেশন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। গৌর খাঁ নিজেই স্টেশনের জন্য জমি দান করেন এবং অন্যান্য সাহায্যও করেন। এইভাবেই জন্ম নেয় মানকুণ্ডু স্টেশন।

গৌর খাঁর শৌখিনতার আরও এক নজির পাওয়া যায় তাঁর মেয়ের বিয়েতে। তাঁর বাড়ির প্রবেশপথের কাছে রেললাইন থাকার কারণে ঘোড়ার গাড়ি সরাসরি প্রবেশ করতে পারত না। কিন্তু তিনি মানতে পারেননি যে জামাইকে মাথা নিচু করে গলাপোল হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসতে হবে। তাই তিনি রেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে নির্দেশ দেন, সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত রেললাইন খুলে দিতে হবে। প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি একরাতের জন্য রেললাইন সরিয়ে নিয়েছিলেন! এই ধরনের বিলাসবহুল খরচ ও অপব্যয়ের কারণেই গৌর খাঁ পরবর্তী জীবনে অর্থাভাবে পড়েন। একসময় বিপুল ধন-সম্পত্তির মালিক এই মানুষটি কার্যত নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তখন থেকেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে একটি প্রবচন— “সাবধানে খরচ করিস, না হলে গৌর খাঁ হয়ে যাবি!” অর্থাৎ, অবিবেচনাহীন খরচ করলে শেষ পর্যন্ত গৌর খাঁর মতো নিঃস্ব হয়ে যেতে হতে পারে।আজও মানকুন্ডু স্টেশনের পাশে তাঁর সেই বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, যা বর্তমানে মানসিক হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে গৌর খাঁর শৌখিন জীবনের এই কাহিনি ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে এবং তাঁর নাম চিরকাল একটি বিখ্যাত প্রবচনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে।