Lionel Messi: লিও হ‌ওয়া সহজ নয়!

ক্রীড়া ফুটবল

শুভম দে: ৩৮ বছর! হ্যাঁ, লোকটা (Lionel Messi) আজ ৩৭৮ -এ পা দিলো। লোকটা আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তা লোকটার নাম যত‌ই লিওনেল মেসি হোক না কেন! ২৪ জুন — দিনটাই যখন সারা বিশ্ব তাঁর কৃতিত্বকে উদযাপন করছে, লোকটা হয়তো ভাবছে —এই ৩৮ বছরে সে কী পেল আর কী হারালো? দেশের জন্য বিশ্বকাপ হয়তো সে আনতে পেরেছে। কিন্তু তারপরেও কী মিলেছে সব পাওয়া না পাওয়ার হিসেব?

আর‌ও পড়ুন: Valentine’s Day: হে প্রেম! তুমি কেন এমন?

আপনি যদি একজন ফুটবলপ্রেমী হন, তবে মেসি (Lionel Messi) আপনার জীবনের বহুদিনের সঙ্গী। আপনার নিশ্চিতভাবে মনে পড়ে যাবে স্কুল থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যখন এসে দাঁড়িয়েছেন আপনি, তখন মেসির মুখে গোঁফ-দাড়ি উঠেছে। লম্বা চুল কেটে ফেলেছে মেসি, আপনিও ধীরে ধীরে বাবার প্রেশারের ওষুধ আর মায়ের চোখে ছানি আর ঘরে অবিবাহিত কোন এক দিদি বা বোনের সকল প্রত্যাশার চাপ ড্রিবল করতে করতে শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে যুবক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু একটা জিনিস বদলায়নি — সপ্তাহের শেষ রাতগুলিতে আপনি এখনও আগের মতোই উত্তেজিত হয়ে পড়েন মেসি ম্যাজিকে। সেই অবিশ্বাস্য ফ্রি-কিকগুলো দেখে আপনার পাগলামি দিন দিন বেড়েছে। পরিবারের গঞ্জনা ভুলতে আপনি বুঁদ হয়ে থেকেছেন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির এক আর্জেন্টাইনের নেশায়।

ইট-কাঠ-ঘাম আর জঞ্জালে ভরা জীবনে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তখন আপনি অপেক্ষা করেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মায়াবী রাতেগুলোর জন্য। রোনাল্ডো-মেসি ক্লাসিকোর আগের শনিবার রাতে বসকে মেসেজ করেছেন—”সোমবার অফিসে একটু দেরি হতে পারে।” জীবনে হতাশা এসেছে, এসেছে আনন্দ, এসেছে ভালোবাসা কিংবা বিচ্ছেদ—তবু আপনি বিশ্বাস করেছেন, মেসি (Lionel Messi) আপনাকে খুব একটা হতাশ করবে না। আপনি অপেক্ষা করে থেকেছেন সেই মুহূর্তটার জন্য। যে মুহূর্ত আপনাকে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব অপ্রাপ্তি।

কিন্তু আপনি জানেন, মেসির (Lionel Messi) পায়ে বল এলেই কী হতে যাচ্ছে। আপনি জানেন, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার জানেন, রেফারি জানেন, মাঠের দর্শক থেকে সারা বিশ্বের মানুষ জানেন। যখন ঐ জাদুকরী বাঁ পায়ে চামড়ার গোলাকার এসে পড়ে, তখন আপনি বুঝে যান—এবার শুরু হবে সেই অবধারিত দৌড়। একে একে কেটে যাবে বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের চক্রবূহ্য, ঠিক অর্জুন পুত্রের শৌর্যে খানখান হয়েছিল কৌরবদের শত প্রচেষ্টা‌।

প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা ট্যাকল করবে, কেউ কেউ হয়তো মেসিকে আটকাতে বল প্রয়োগ‌ও করবে কিন্তু আপনি জানেন, মেসি থামবে না। বছর আটত্রিশের লোকটার তখন মনে পড়বে এক ছোট্ট বালকের কথা। সেও যখন রোজারিওর মাঠে পড়ে যেত ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াত বারবার। পা ছাড়া হতো না বলটা। পায়ে লেগে থাকতো। বড় হয়ে উঠলেও বলটা যেন চুম্বকের মতো এখন‌ও পায়েই আটকে থাকে।

আপনি দেখছেন সে ডান দিকে ছুটছে, জায়গা খুঁজছে শট নেওয়ার জন্য, ডিফেন্ডার আর গোলকিপাররা জানেন কী আসতে চলেছে — ঐশ্বরিক বাঁ পায়ে এক কম্পাস-মাপা শট। পুরো দৃশ্য যেন সিনেমার ধীরগতির একটি দৃশ্য। বিপক্ষ দলের তখন মনে পড়বে ড্রেসিংরুমের কথা। বারবার বলা হতো, প্র্যাকটিসে যে মেসি এমন ভাবেই শট নেয়। কিন্তু ভাগ্যকে থামানো যায় কি? গোলকিপার জানেন কোন দিক থেকে শট আসবে ফ্রিকিকে। তবু দৃশ্যটা যেন রূপকথার মতো। সেই বাঁকা ফ্রিকিক যেন নিখুঁত ক্ষেপণাস্ত্র হয়ে জালে ঢুকে পড়ে।

আজকের দিনে হয়তো আপনার মনে জমছে মনখারাপের দিস্তা। ভাবছেন —ধীরে ধীরে সময় ফুরিয়ে আসছে। বয়স তো ৩০ ছাড়িয়ে অনেক আগেই ভুল পথে পা রেখেছে। বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করেছে। বয়স তার ছাপ ফেলেছে লিওর ওপর—সে আর আগের মতো ডিফেন্সে সাহায্য করে না, আর তেমন দৌড় শুরু করে না, সহজেই প্রতিপক্ষ এখন থামিয়ে দেয় তাঁর দুর্বার গতি! এখন সে নিজে গোল করার থেকে খেলাটা তৈরি করার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।

তবু অদ্ভুত ব্যাপার, এই বয়সেও দল এখনও তাঁর ওপরই ভরসা রাখে গোলের জন্য। মেসিকে (Lionel Messi) ছাড়া দল যেন পথ হারিয়ে ফেলে। এখন‌ও আর্জেন্টিনা বা ইন্টার মিয়ামি হারলে পরদিন সংবাদ মাধ্যমে সেই তাঁর নাম‌ই উঠে আসে। কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে। একটা সময় আসবে, যখন তাঁকে থামতে হবে। আমাদে সবাইকেই থামতে হয়। গায়ে উঠবে না আর নীল-সাদা ১০ নম্বর জার্সি —এই সত্যটা মানতেই হবে, কারণ প্রতিটি জন্মদিন ধীরে ধীরে আমাদের সেই বাস্তবতার কাছেই নিয়ে যায়।

আপনি তাঁর ফ্যান নাও হতে পারেন তবু হয়তো একটু বিষণ্ণতা গ্রাস করবে আপনাকে, এটা ভেবে যে— মেসিবিহীন ফুটবল! আমাদের অনেকেই এখনও সেদৃশ্য কল্পনা করতে পারি না।

মেসি বার্সার হয়ে যা কিছু জেতা সম্ভব, সব জিতেছে। দেশের হয়েও বহু অপেক্ষার অধরা সেই বিশ্বকাপ তাও জিতেছে। তবুও আর্জেন্টিনার ভালোবাসা পেতে তাঁর সারা জীবন কেটে গেল প্রায়। মারাদোনা, তেভেজ ফুটপথে খেলেই বড় হয়েছে, তাই আবেগে আর্জেন্টাইনরা তাদের আপন করে নিয়েছে। কিন্তু মেসিকে তারা সবসময়ই দেখেছে ‘সৎ’ ছেলে হিসেবে, যে মাঝে মাঝে ছুটিতে দেশে আসে। তাঁর মধ্যে কখনো মারাদোনার সেই আকর্ষণ ছিল না। তেভেজও তাঁর থেকে বেশি জনপ্রিয় ছিল। এমনকি তাঁর নিজের শহরেও তাঁর মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। মারাদোনাকে কখন‌ও অন্য কারো মতো হতে হয়নি। কিন্তু মেসিকে সারাজীবন হতে হয়েছে মারাদোনার মতো।

কিন্তু মেসি (Lionel Messi) বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আজও একজন খাঁটি আর্জেন্টাইন। এখনও তিনি রোজারিওর ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, ছুটি পেলেই ছুটে যান সেখানেই। এত বছর স্পেনে কাটালেও রোজারিওর খাবারই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। বারংবার বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পরেও তিনি দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছেন সবসময়। তথাকথিত ‘অবসর নাটক’-এর পর আবার আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। কারণ আর্জেন্টিনাকেও সেই ত্রিশোর্ধ মেসির ‌ওপরই নির্ভর করতে হয়েছিল বিশ্বকাপে যেতে, নাহলে রথের চাকা সেখানেই থেমে যেত! আর সেই পুরোনো ঘোড়াই নিজের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল দেশের জন্য একটিমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের আশায়।

লিও অনেক সমালোচনার উত্তর দেননি, কিন্তু চাইলে তিনি দিতে পারতেন। তিনি পুরো ক্যারিয়ারটাই প্রায় কাটিয়েছেন বার্সেলোনায়। সমালোচকরা বলেন, তিনি নাকি অন্য লিগে চ্যালেঞ্জ নিতে চাননি। বিশ্বকাপ নিয়ে যত আলোচনাই হোক না কেন, মনে রাখা উচিত মারাদোনার বিশ্বকাপ জয়ও সম্ভব হতো না যদি বুরুচাগা গোল না করতেন। কিন্তু হিগুয়াইনরা যদি বুরুচাগার মতো হতেন, তাহলে অনেক বিতর্কেরই অবসান হতো অনেক আগেই। তবুও মেসি কোনও অভিযোগ করেননি। হয়তো তিনি যদি একটু বেশি একস্ট্রোভার্ট হতেন, তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। অন্তত নিজের মনের কথা বলতে পারতেন। হয়তো তিনি মাঠে একজন ‘নেতা’ -র মতো নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি, কারণ তিনি সবসময় পেছনেই থাকতে পছন্দ করেছেন। কিন্তু চাইলেই মেসি বলতে পারতেন যে, শুধু বার্সেলোনাকেই নয়, শুরু থেকেই আর্জেন্টিনাকেও নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। তার জন্য একটা বিশ্বকাপ দিয়ে কোন‌ওকিছু প্রমাণ করতে হতো না তাঁকে। কিন্তু তিনি সবসময়ই নীরব থেকেছেন।

মেসি (Lionel Messi) আদৌ সর্বকালের সেরা তালিকায় আছেন কি না, বা রোনাল্ডো না মেসি —কে সেরা? এইসব বিতর্কের কোনও মানেই নেই। একটা ব্যালন ডি’অর বা একটা বিশ্বকাপ দিয়ে তাঁকে বিচার করাটা শিশুসুলভ। আপনি বার্সেলোনা বা আর্জেন্টিনার সমর্থক হোন বা না হোন, তাঁকে ভালোবাসেন বা ঘৃণা করেন— এসব কিছুতেই কিছু যায় আসে না। শুধু নিজেকে কল্পনা করে দেখুন সেই আফগান শিশুটির জায়গায়, যার নাম মুর্তজা আহমাদি, যে প্লাস্টিকের LM10 লেখা জার্সি গায়ে চাপিয়ে কখনও মেসিকে ছাড়তে চায় না। আসলে মেসি বেঁচে থাকবেন মুর্তজার মতো আরও অনেক শিশুর হৃদয়ে। তাঁর সফলতা, তাঁর ব্যর্থতা নিয়ে অনেক লেখা হবে, অনেক সমালোচনাও চলবে —কিন্তু জানেন কী? এগুলোর কোনওটাই আদতে গুরুত্বপূর্ণ নয়!

নিউজ পোল বাংলা ইউটিউব চ্যানেলের লিংক: https://youtube.com/@thenewspole?si=DYt-LCI4oSgt7Q9m

কারণ মেসি (Lionel Messi) নিজেই বলেছেন, আজও মাঠে নামা তাঁর কাছে ঠিক ততটাই আনন্দের, যতটা ছিল রোজারিওর রাস্তায় ছোটবেলায় খেলার সময়। কতজন ফুটবলারের মধ্যে থাকে খেলাটার এমন নিখাদ আনন্দ? আর হাতে গোনা কয়েকটা দিনই তো বাকি— তাহলে কেন সেই আনন্দ থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন? এই পথ চলার আনন্দ, এই জীবনের আনন্দ।

শুভ জন্মদিন লিও!