নিউজ পোল ব্যুরো: নবাবদের শহর মুর্শিদাবাদ আজও বহন করে চলেছে তিন শতকের পুরনো ইতিহাসের স্মৃতি। এই জেলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে নবাবি আমলের একাধিক স্থাপত্য, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তবে, বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এই কর্মীদের বেতন আজও সেই ৩০০ বছর আগের হারেই রয়ে গিয়েছে! নবাবি আমলে তাঁরা যে পরিমাণ বেতন পেতেন, আধুনিক প্রযুক্তি আর সভ্যতার অগ্রগতির যুগেও তাঁদের জীবন সেই প্রাচীন কালের আর্থিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
মুর্শিদাবাদের নবাবি স্থাপত্যগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনকারী কর্মীরা আজও পাচ্ছেন নামমাত্র বেতন। নবাবি আমলে যেখানে বাগানের মালিদের মাসিক বেতন ছিল ৫ টাকা, আর মহল সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের বেতন ছিল ৯ টাকা, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও সেই একই পরিমাণ টাকা তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে! সময়ের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও, তাঁদের এই নগণ্য আয় কখনই সংশোধিত হয়নি। তবুও তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই কর্মীরা নিজেদের বেতন বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জেলা প্রশাসনের কাছে ডেপুটেশন জমা দিয়েছিলেন নবাবি এস্টেটের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কর্মী ইউনিয়নের সদস্যরা। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও কোনও আশার আলো দেখা যায়নি। তাই এবার বৃহত্তর আন্দোলনের পথে হাঁটার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, যদি দ্রুত বেতন কাঠামোর পরিবর্তন না হয়, তাহলে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে আমরণ অনশনে বসবেন অথবা চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন তাঁরা।
মুর্শিদাবাদের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হাজারদুয়ারি প্যালেস থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত জাফরগঞ্জ, যেখানে মীরজাফর ও তাঁর পরিবারের সমাধিস্থল রয়েছে। এখানেও নবাবি স্থাপত্যগুলোর মতোই কিছু কর্মী রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের বেতনও ৩০০ বছর আগের মতো মাত্র ৫ টাকা! তাঁরা ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘‘সরকার হাজারদুয়ারি থেকে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করলেও আমাদের দিকে তাকায় না। হয়তো মীরজাফর ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেই এই সমাধিস্থল ও আমরা ব্রাত্য হয়ে পড়েছে।’’ একইভাবে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক মতিঝিলেও অবহেলার শিকার কর্মীরা। এখানে নিযুক্ত সুপারিনটেনডেন্ট মহম্মদ আরিফ হোসেন জানিয়েছেন, ‘‘আমার বেতন মাত্র ৫০ টাকা! আমার অধীনে কাজ করা কর্মীদের কেউ ৫ টাকা, কেউ ১০ টাকা বেতন পান। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কাজ করতে আমাদের লজ্জা লাগে।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বেতন কাঠামো পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে এবার প্রশাসন দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন তাঁরা।
যে কর্মীরা যুগ যুগ ধরে নবাবি ঐতিহ্যকে আগলে রেখেছেন, তাঁরা নিজেরাই আজ অবহেলিত। তাঁদের বেতন কাঠামো এখনও নবাবি যুগেই রয়ে গিয়েছে, অথচ তাঁরা আধুনিক সময়ের দাসত্ব করে চলেছেন। এখন দেখার বিষয়, কতদিনে তাঁদের ন্যায্য দাবি পূরণ হবে এবং তাঁরা সভ্য সমাজের উপযুক্ত সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করবেন।