নিজস্ব প্রতিনিধি, হুগলি: প্রকৃতির রঙিন আভায় মোড়া ময়ূর,আমাদের জাতীয় পাখি, তার সৌন্দর্য্য ও নাচের জন্য চিরকালই মানুষের মন কেড়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই পাখির এক বিশেষ স্থান রয়েছে। তবে দুঃখজনকভাবে, আজকের দিনে প্রকৃতির এই অনন্য সৃষ্টি বিলুপ্তির পথে দাঁড়িয়ে। হুগলির রাজহাট গ্রাম যেটিকে এখন ‘ময়ূর মহল’ বলা হয়, সেখানে এক সময় শত শত নীলকণ্ঠী ময়ূরের অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু আজ ক্রমাগত বন কেটে ফেলা, খাদ্য সংকট, পরিবেশের পরিবর্তন ও মানুষের অসচেতন আচরণের কারণে তাদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
হুগলির রাজহাট গ্রাম একসময় ময়ূরের স্বর্গরাজ্য ছিল। জয়সলমিরের মতো এখানে গ্রামের পথে, গাছপালার ছায়ায় ও নদীর ধারে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর দেখা যেত। গান্ধীগ্রাম, ভাদুরিয়া, সুগন্ধা, আমপারা, আলিআসকে এলাকার মাঠে ঘটে অবাধে ঘুরে বেড়াত তারা। গ্রামবাসীদের সঙ্গেই তাদের বসবাস ছিল, এমনকি অনেকেই ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন – পুটুপুটু, রুমকি – ঝুমকি। কিন্তু এখন চিত্র বদলেছে। ছয় সাত বছর আগেও যেখানে পাঁচশো থেকে সাতশো ময়ূরের ঝাঁক দেখা যেত, সেখানে এখন সংখ্যাটা দ্রুত কমেছে। একসময় কুন্তি নদীর তীরে বাঁশবনে ময়ূরেরা বাস করত, সেখানেই ডিম দিত। কিন্তু নদীর গতি থমকে যাওয়া, বনভূমি উজাড় হওয়া, শিকার ও ডিম চুরির কারণে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিলাবৃষ্টি এমনকি কুকুরের আক্রমণেও বহু ময়ূরের মৃত্যু হয়েছে। পর্যটকরাও তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গ্রামে ঘুরতে এসে ময়ূর দেখলেই তাঁরা কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন, পিকনিকের উচ্চ শব্দে ময়ূরেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীরা নিষেধ করলেও অনেকেই শোনেন না।

প্রায় দেড়শো বছর আগে রাজহাটের জমিদার নীলমনি চক্রবর্তীর বাড়িতে প্রথম ময়ূর আনা হয়। সেখান থেকে বংশবিস্তার করে হাজারেরও বেশি ময়ূর ছড়িয়ে পড়ে। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ময়ূরেরা মুক্ত পরিবেশে বসবাস শুরু করে। প্রকৃতির কীটপতঙ্গ খেয়েই তারা বেঁচে থাকত, কিন্তু বন উজাড় হওয়ায় খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। গ্রামের কোল্লা পরিবার ময়ূরদের বাঁচাতে প্রতিদিন চাল গম সরবরাহ করে। স্থানীয় বিধায়ক ও পুলিশও এই কাজে তাঁদের সাহায্য করে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। গ্রামের বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ কোল্লা জানান, সরকার যদি উদ্যোগ না নেয় তবে রাজহাটের ঐতিহ্য একদিন হারিয়ে যাবে। জেলা পরিষদের সভাধিপতি রঞ্জন ধারা জানান, ‘ময়ূরদের রক্ষা ও পর্যটনের উন্নয়নের জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি।’ আজও ময়ূর পেখম মেলে নাচে ঠিকই কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।