নিউজ পোল ব্যুরো : শুক্রবার ১৪ ফেব্রুয়ারি শেয়ার বাজার (Share Market) শুরুর দিকে ইতিবাচক প্রবণতা দেখালেও শেষ পর্যন্ত আবারও লাল চিহ্নে ফিরে আসে। টানা আটদিন ধরে সেনসেক্স ও নিফটি নিম্নমুখী রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে একাধিক বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের (Investor) আস্থায় প্রভাব ফেলছে।মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের (Modi-Trump meeting ) সিদ্ধান্তগুলোর বাজারে তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং, ট্রাম্পের ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ (পারস্পরিক শুল্ক) নীতির ঘোষণা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
দুপুরের বাণিজ্যে সেনসেক্স (Sensex) ৫৫০.১১ পয়েন্ট বা ০.৭২ শতাংশ কমে ৭৫,৫৮৮.৮৬-তে পৌঁছে যায়। একইভাবে, এনএসই নিফটি ১৮৮.১ পয়েন্ট বা ০.৮১ শতাংশ কমে ২২,৮৪৩.৩০-এ নেমে আসে। দিন শেষে সেনসেক্স (Sensex) কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ১৯৯ পয়েন্ট পতনের সাথে ৭৫,৯৩৯-এ বন্ধ হয়, এবং নিফটি (Nifty) ১০২ পয়েন্ট কমে ২২,৯২৯-এ স্থির হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে এই পতনের মূলত তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে:
শেয়ার বাজারের পতনের তিনটি প্রধান কারণ —
১. ট্রাম্পের ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানল
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ‘রেসিপ্রোকাল ট্যাক্স’ (Reciprocal Tax) নীতির পুনরাবৃত্তি করেছেন, যার অর্থ হলো, ভারত যদি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তবে আমেরিকাও সমান পরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে। এটি বৈশ্বিক বাজারের জন্য একটি নেতিবাচক সংকেত পাঠিয়েছে, কারণ এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। যদিও মোদি ও ট্রাম্প একটি বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত-আমেরিকার India-USA) দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, তবে এই চুক্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে, যা বাজারে বিক্রির চাপ বাড়িয়েছে।
২. বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লাগাতার শেয়ার বিক্রি
বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (FIIs) ভারতীয় শেয়ার বাজার থেকে ক্রমাগত টাকা তুলে নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে তারা এখন পর্যন্ত ১৯,০৭৭ কোটি টাকা বাজার থেকে বের করে নিয়েছে।
জানুয়ারি মাসেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৭৮,০২৭ কোটি টাকা বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছিল, যা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বৃহস্পতিবারও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২,৭৮৯.৯১ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই বড় পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের কারণ মূলত ভারতীয় মুদ্রার দুর্বলতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা ভারতীয় শেয়ার বাজারকেও প্রভাবিত করছে, ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদী ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চাইছেন।
৩. তৃতীয় ত্রৈমাসিকের দুর্বল ফলাফল বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে
বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানি তাদের তৃতীয় ত্রৈমাসিক (Q3) ফলাফল প্রকাশ করেছে, যা বিনিয়োগকারীদের আশানুরূপ ছিল না। ফলে এই সংস্থাগুলোর শেয়ারে বড় বিক্রির চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষত, ন্যাটকো ফার্মা (Nakto Faram), সেনকো গোল্ড (Senco Gold) এবং দীপক নাইট্রাইট (Deepak Naitrait) -এর মতো সংস্থাগুলোর শেয়ার তাদের দুর্বল ফলাফলের কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়াও, FMCG কোম্পানিগুলোর শেয়ারেও বিক্রির চাপ দেখা গেছে, যা দুর্বল ভোক্তা চাহিদার ইঙ্গিত দেয়। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি ভোক্তা চাহিদা দ্রুত পুনরুদ্ধার না হয়, তাহলে বাজারের এই মন্দাভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
টেকনিক্যাল বিশ্লেষকদের মতামত:
জিয়োজিত ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট আনন্দ জেমস বলেন, ‘নিফটি ২৩,২২০-তে শক্তিশালী রেজিস্ট্যান্সের মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে আগের সেশনে পতন দেখা গিয়েছিল। যদি সূচক ২৩,২২০-এর ওপরে থাকতে ব্যর্থ হয় বা ২৩,০০০-এর নিচে নামে, তাহলে বাজারের গতি আরও দুর্বল হতে পারে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘নিফটির ২৩,৪৩০-এর আপসাইড লক্ষ্য এখনও বহাল রয়েছে, তবে ২২,৮০০-এর নিচে গেলে নতুন করে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে।’
ভারতীয় শেয়ার বাজারের সাম্প্রতিক পতনের পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। ট্রাম্পের ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ (Reciprocal Tariff) নীতি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের (Foreigner Investor) ক্রমাগত শেয়ার বিক্রি এবং বড়ো কোম্পানিগুলোর দুর্বল ত্রৈমাসিক ফলাফল— এই তিনটি বিষয় মিলিয়ে বাজারের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ শেয়ার বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত বাজারের গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। এখন দেখার বিষয়, আগামী দিনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে কি না, নাকি পতন অব্যাহত থাকবে।