মোবাইল কেড়ে নিতে পারে ওদের ভবিষ্যৎ

অপরাধ দেশ প্রযুক্তি বিজ্ঞান স্বাস্থ্য

নিউজ পোল ব্যুরো: ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই একটি রচনা পড়েছিলাম: ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ।’ কেউ বিজ্ঞানকে অভিশাপ বলে আখ্যায়িত করত, আবার কেউ বা‌ বলত এটি মানবজীবনের এক অসীম আশীর্বাদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রভাব ও ব্যবহার আমাদের জীবনে আরও গভীর হয়েছে। এরই এক অন্যতম উদাহরণ হল মোবাইল ফোন। বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। কাজ থেকে শুরু করে বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা—প্রায় সব ক্ষেত্রেই মোবাইল ফোন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এক কথায়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ।

আজকের আধুনিক জীবনে প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনই এর অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সমাজে নানা সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে, শিশুদের মধ্যে স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কলকাতার একটি পার্কে সমবয়সী দুই শিশু, সৌম্য এবং প্রিয়া, খেলা করছিল। খেলায় মগ্ন সৌম্যকে দেখে প্রিয়ার মা তার নাম জানতে চাইলেন। কিন্তু সৌম্য কিছুতেই নিজের নাম বলতে পারছিল না। কথা বলতে তার বেশ সমস্যা হচ্ছিল। প্রিয়ার মা বিষয়টি বুঝতে পেরে সৌম্যর মায়ের কাছে গিয়ে ছেলেটির সমস্যার কারণ জানতে চান। সৌম্যর মা প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তবে কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি জানান যে, ছোট বয়সে নিজের কাজের সুবিধার্থে তাঁর ছেলেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। প্রথমে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে সৌম্যর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সে কথা বলার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলে।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বড় থেকে ছোট, প্রায় সকলেই কোন না কোনোভাবে মোবাইল ফোনের উপর নির্ভরশীল। তবে লক্ষ্য করা গিয়েছে, মোবাইল আসক্তির এই প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রিলস এবং ইউটিউব শর্টসের মতো ছোট ভিডিও কনটেন্ট মানুষকে আকর্ষিত করছে। রিলস এবং ইউটিউব শর্টসের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। এগুলো সহজলভ্য এবং স্বল্পসময়ের বিনোদন হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর তথ্য অনুসারে দেখা গিয়েছে, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব—সব জায়গাতেই ইনফ্লুয়েন্সারদের তৈরি করা একগুচ্ছ কনটেন্টের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তরুণ এবং মধ্যবয়সীরা প্রায়শই কাজের ব্যস্ততা থেকে সামান্য বিরতি নেওয়ার জন্য ১০ মিনিটের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করেন। কিন্তু সেই ১০ মিনিট কখন যে ২ ঘণ্টায় রূপান্তরিত হয়, তা তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেন না। শুধু সময় নষ্টই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। একটানা মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। এই অতিরিক্ত মানসিক চাপ ধীরে ধীরে হাইপারটেনশন এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

চিনের হেবেই মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে রিল বা শর্টস ভিডিও দেখার ফলে শরীরে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই গবেষণাটি বি.এম.সি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে প্রায় ৪৩১৮ জন তরুণ এবং মধ্যবয়সী মানুষের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, যাঁরা নিয়মিত বেশি সময় ধরে মোবাইল স্ক্রিনের সামনে রিল বা শর্টস ভিডিও দেখেন, তাঁদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন হেবেই মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ফেংদে লি, ফাংফাং মা, শাংইউ লিউ, লে ওয়াং, লিশুয়াং জি, মিংকি ঝেং এবং গ্যাং লিউ। তাঁরা সুপারিশ করেছেন, রিল দেখার সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ঘুমের সময় ভিডিও দেখার অভ্যাস পরিহার করা প্রয়োজন। অতএব, মোবাইল ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো এবং সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘ সময় ধরে রিল দেখা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য করা হলেও, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের এই অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন।