মহাকুম্ভের প্রতি সবচেয়ে আগ্রহী পাকিস্তান! আমরা নই, বলছে সমীক্ষা

আন্তর্জাতিক দেশ ভ্রমণ সংস্কৃতি

নিউজ পোল ব্যুরো : আগামী ১৩ জানুয়ারী থেকে শুরু হয়েছে মহাকুম্ভ মেলা যা চলবে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। এই মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে পূণ্যার্থীদের ভিড় লেগেই আছে। মহাকুম্ভ মেলার আয়োজনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেনি যোগী সরকার। এছাড়া রয়েছে কড়া নিরাপত্তা। আরও একটি মজার বিষয় হল মহাকুম্ভ নিয়ে সার্চ করলে দেখা যাচ্ছে গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। এতো বড়ো উৎসবকে সম্মান জানতেই হয়তো গুগলের তরফ থেকে এই উদ্যোগ। তবে জানেন কি এই মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী কোন দেশ? এক সমীক্ষায় জানা গেছে মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। বিষয়টি অবাক লাগলেও এমন তথ্য সামনে এসেছে।

আসলে ট্রেন্ডিং ট্রপিক সার্চের মধ্যে মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি সার্চ করেছে তার ওপর একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। এর থেকেই জানা যায় গুগলে সবচেয়ে বেশিবার সার্চ করেছে পাকিস্তান। শুধুমাত্র পাকিস্তান নয় এই তালিকায় আছে কাতার, সংযুক্ত আবর আমিরশাহী, বাহরিন প্রভৃতি দেশ। সমীক্ষায় আরও জানা যায়, ট্রেন্ডিং এই টপিক নিয়ে নেপাল, সিঙ্গাপুর, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড ও মার্কিন নাগরিকেরা প্রচুর পরিমানে সার্চ করেছেন। এই মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে বিশ্ববাসীর মনে আলাদাই একটা আগ্রহ। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে সেই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে আরও কয়েক গুলি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বলাই যায় সারাবিশ্বে মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে আকর্ষণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসবকে আপন করে নিয়েছে সকল মানুষ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথের ডিজিটাল ভাবনা এই মহাকুম্ভ মেলাকে আরও সার্থক করে তুলেছে। মহাকুম্ভ মেলা নিয়ে একটি ওয়েব সাইটে খোলা হয়েছে। এই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে এই মেলা নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ওয়েব সাইটে প্রবেশ করছে ও এই মেলা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সার্চ করছেন। এই ওয়েব সাইটের নিযুক্ত কর্মীরা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত ৪ জানুয়ারী থেকে এখনও পর্যন্ত ১৮৩ টি দেশের ৬২০০ শহরের ৩৩ লক্ষ মানুষ এই মেলা নিয়ে সার্চ করেছেন। এই মেলা নিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি যেসব প্রশ্ন সার্চ করেছে তা হল কুম্ভ মেলা কি? মহাকুম্ভ মেলা কি? কিভাবে এই মেলা শুরু হয়েছিল?

চলুন এই মহাকুম্ভ মেলা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ——-

কেন শুরু হল কুম্ভমেলা?

কুম্ভ মেলা কী ভাবে শুরু হল তা নিয়ে পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। একবার ঋষি দুর্বাসার অভিশাপে শ্রী হীন হয়ে পরে দেবতারা। তখন দেবতারা ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আশ্রয় নেন পাতাল লোকে। অন্ধকার ছেয়ে যায় বৈকুন্ঠ লোকে। এরপরেই ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন দেবতারা। তাঁর পরামর্শে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন সমুদ্র মন্থন। একের পর এক মূল্যবান হিরে-মানিকের সঙ্গে উঠে আসে কলস ভর্তি অমৃত।

অমৃতর ঘড়া উঠে আসতেই তা দাবি করে বসেন অসুররা। তখন ১২ দিন ধরে সেই ঘড়াকে নিয়ে অসুর এবং দেবতাদের মধ্যে চলে ভীষণ যুদ্ধ। সেই সময় পৃথিবীর চারস্থানে চার ফোঁটা অমৃত পড়ে যায়। সেই সময় চন্দ্র কুম্ভকে ক্ষরণ থেকে, সূর্য কুম্ভ বিস্ফোরণ থেকে, দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরদের অপহরণ থেকে এবং শনি দেবেন্দ্রের ভয় থেকে অমৃতের ঘড়াকে রক্ষা করেছিলেন। শেষে ভগবান বিষ্ণু মোহিনী অবতারে অমৃত বন্টন করে যুদ্ধের অবসান ঘটান। দেবতা-অসুরের ১২ দিনের যুদ্ধ মনুষ্য লোকে ১২ বছরের সমান। তাই ১২টি কুম্ভ রয়েছে। যার ৪টি (প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার , উজ্জয়িনী , নাসিক) রয়েছে পৃথিবীতে বাকি ৮ কুম্ভ আছে দেবলোকে। মনুষ্য লোকের এই ৪ কুম্ভেই গ্রহের অবস্থান দেখে আয়োজন করা হয় কুম্ভ মেলার।

কুম্ভ কত রকম ?

পৃথিবীতে ৪ রকমের কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়।

১) পূর্ণ কুম্ভ – প্রতি ১২ বছর অন্তর প্রয়াগরাজে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমে আয়োজিত হয় পূর্ণ কুম্ভ মেলা।
২) অর্ধ কুম্ভ – প্রত্যেক ৬ বছর অন্তর গ্রহের অবস্থান দেখে অর্ধ কুম্ভের আয়োজন করা হয়, প্রয়াগরাজ বা উজ্জয়িনীতে।
৩) কুম্ভ – প্রত্যেকে ৩ বছর অন্তর গ্রহের অবস্থান দেখে আয়োজিত হয় কুম্ভ মেলা। এমনকি সেই অনুসারেই ৪ কুম্ভের মধ্যে কোথায় সেই বছর মেলা হবে তা ঠিক করা হয়।

কুম্ভমেলার তারিখ নির্ধারণ করা হয় সূর্য ও বৃহস্পতির অবস্থান দেখে। কখন ও কোথায় কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হবে তা নির্ধারণ করা হয় গ্রহ ও রাশিচক্রের অবস্থান দেখে। বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে ও সূর্য মকর রাশিতে থাকলে প্রয়াগে মেলার আয়োজন করা হয়। যখন সূর্য মেষ রাশিতে থাকে ও বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে থাকে তখন হরিদ্বারে কুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। যখন সূর্য এবং বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে থাকে, তখন নাসিকে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতি যখন সিংহ রাশিতে এবং সূর্য মেষ রাশিতে থাকে, তখন উজ্জয়িনীতে কুম্ভের আয়োজন করা হয়।

৪) মহাকুম্ভ – এবারে এই বছরের মূল আকর্ষণ মহাকুম্ভের কথায়। মহাকুম্ভ অনুষ্ঠীত হয় ১৪৪ বছরে একবার। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, মেষ রাশির চক্রে বৃহস্পতি, সূর্য ও চন্দ্র মকর রাশিতে প্রবেশ করলে মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয়।

আসলে ১২ বছরের পূর্ণ কুম্ভের ১২টি চক্র পূর্ণ হলে তবেই তৈরি হয় মহাকুম্ভের যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে কেউ খুব ভাগ্যবান হলে নিজের সারা জীবনে একবার এই মহাকুম্ভে যাওয়ার সুযোগ পান।

সাধু সন্ন্যাসীদের কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মহাকুম্ভ?

কেবল মহাকুম্ভই নয়, নাগা সাধু, সন্ন্যাসী, অঘোরিদের কাছে সব কুম্ভই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে নিজের ব্রহ্মচারী দশার কঠোর ত্যাগের পরে নাগা সাধু হওয়ার যোগ তৈরি হয়। অঘোরিরাও বিশেষ যোগের সময় নানা ধরনের পুজো পাঠ, সাধনা করে থাকেন। বিশ্বাস, কুম্ভ মেলায় ৪৫ দিন ধরে কল্পবাসের পরে সাধনা করে পুণ্য লগ্নে গঙ্গায় মহাস্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। তাই দেশ-বিদেশ থেকে সকলে এসে ভিড় জমান এই কুম্ভ মেলায়।

পৌরাণিক বিশ্বাস মহাকুম্ভের সময় পৃথিবীতে স্বর্গের দরজা খুলে যায়, দেবতারাও পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং পবিত্র সঙ্গমে স্নান করেন। শিবপুরাণ অনুসারে, ভগবান শিব, দেবী পার্বতী এবং কৈলাসের অন্যান্য বাসিন্দারা মাঘ পূর্ণিমার দিনে ছদ্মবেশে কুম্ভে আসেন। জ্যোতিষীরা বলছেন, এই সময়ে সূর্য, শনি, চন্দ্র ও বৃহস্পতির অবস্থান সাগর মন্থনের সময়ে যেমন ছিল। এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে এবং মানবদেহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই মহাকুম্ভ মেলা আধ্যাত্মিক পাশাপাশি বস্তুগত দিক থেকেও উপকারী।

কুম্ভমেলা কবে শুরু হয়েছিল?

কুম্ভমেলা সঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে এই মেলা কয়েকশো বছরের পুরনো তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেকের মতে অষ্টম শতাব্দীতে হিন্দু দার্শনিক ও সাধু আদি শংকরাচার্য ভারত জুড়ে মঠ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সমাবেশ করেন। মনে করা হয় সেই সময় তাঁর হাত ধরেই এই মেলার সূচনা হয়েছিল। যদিও এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

স্বাধীনতার আগে এই কুম্ভ মেলার আয়োজন করত খোদ ব্রিটিশ সরকার। সেই সময়ে কেবল কুম্ভ মেলার খুঁটিনাটি, সুরক্ষার দিক সব খতিয়ে দেখতে ইংল্যান্ড থেকে জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার আসতেন শুধুমাত্র কুম্ভ মেলার আয়োজনের তদারকি করতে। ক্রমে দেশ স্বাধীন হয়, ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজেও প্রথম আয়োজন হয়েছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম কুম্ভ মেলার। কুম্ভে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেছিলেন খোদ জহরলাল নেহেরু, উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদও। সেই বছর সেই কুম্ভ মেলায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ১২ কোটি মানুষ।